ষোল বিটের একটা কোড দিয়ে আমার হিসাব রাখা হয়। হাতের চামড়ার নিচে একটা পালসার ছিল, খুলে ফেলেছি।
কী বলছ তুমি? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
মেয়েটা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, পারবে না। মাঝে মাঝে আমি নিজেও বুঝতে পারি না। তুমি যদি চাও আমাকে কোনো একটা নাম দিয়ে ডাকতে পার।
একজন মানুষ নাম ছাড়া কীভাবে বেঁচে থাকতে পারে?
আমি মানুষ নই।
তুমি কী?
মনে হয় একটা দানবী। একটা পিশাচী
ইশি ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ, কিরি। এটি একটি দানবী। একটি পিশাচী। তুমি একে হত্যা কর।
মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, তুমি আমাকে হত্যা কর।
আমি চমকে উঠে বললাম, তুমি কীভাবে আমার ট্রাকিওশানের কথা শুনতে পাও? সে বলছে সরাসরি মস্তিষ্কে কোনো শব্দ না করে।
পিশাচীরা মনের কথা শুনতে পারে।
তুমি নিশ্চয়ই একটা রোবট। কাছাকাছি বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় রেডিয়েশান ধরতে পার।
মেয়েটি কোনো কথা বলল না, আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ইশি ফিসফিস করে বলল, হত্যা কর। হত্যা কর। হত্যা–
আমি একটু অধৈর্য হয়ে আমার মস্তিস্কে বসানো ট্রাকিওশানকে বললাম, আমি যখন চাইব তখন করব। তুমি চুপ কর ইশি।
তুমি বুঝতে পারছ না। তোমার জীবনের ওপর প্রচণ্ড ঝুঁকি
তুমি চুপ কর।
তোমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেই দায়িত্বের অবহেলা করতে পার না তুমি।
তুমি সিস্টেম সাতানব্বই গ্রুপ বারো পয়েন্ট বি, আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে তুমি। আমি যখন তোমার সাহায্য চাইব তুমি সাহায্য করবে। না–হয় তুমি আমার সাথে কথা বলবে
মেয়েটি স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল, তার মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল সে আমাদের সব কথা শুনতে পাচ্ছে। তার মুখে ধীরে ধীরে বিচিত্র একটা হাসি ফুটে ওঠে, হঠাৎ করে প্রায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে উঠল, আমি কখনো অন্য কারো ভালবাসা পাই নি। কারো স্নেহ–মমতা পাই নি। তুমি জান আমাকে কেউ কখনো কোনো দয়া কথা বলে নি।
আমি মেয়েটির দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম, মেয়েটির দৃষ্টিতে হঠাৎ একটা কৌতুকের চিহ্ন ফুটে উঠল, বলল, তাই আমি ঠিক করেছি যে–কারো ভালবাসা পেলে শুধু তাকেই আমি ভালবাসব।
ইশি হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার করে বলল, না।
আমি চমকে ওকে বললাম, কী হল ইশি?
ইশি উত্তর দেবার আগেই মেয়েটা আমার চোখে চোখ রেখে বলল, কিরি! কী মনে হয় তোমার? আমি কি নিজেকে ভালবাসি?
না–না–না–ইশি আমার মস্তিষ্কে আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কী হয়েছে ইশি? কী হয়েছে তোমার?
আমার মস্তিষ্কে ইশি কোনো উত্তর দিল না, চাপা কান্নার মতো এক ধরনের শব্দ করতে লাগল। আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম, কী হয়েছে এখনো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। মেয়েটি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, সিস্টেম সাতানব্বই গ্রুপ বারো পয়েন্ট বি খুব দুর্বল সিস্টেম। সহজ প্রশ্নটাতেই তোমার ট্রাকিওশান কেমন জট পাকিয়ে গেল দেখেছ?
কী প্রশ্ন করেছ তুমি?
ছেলেমানুষি একটা প্রশ্ন। একটা প্যারাডক্স। আনুষের কাছে এই প্রশ্নের কোনো সমস্যা নেই–যন্ত্রের কাছে সমস্যা। সে কখনো তার উত্তর খুঁজে পাবে না। একটু সময় দাও, টেরা ওয়ার্ড মেমোরি শেষ হবার সাথে সাথে ওর সিস্টেম ধসে যাবে। তোমাকে আর বিরক্ত করবে না।
আর আমাকে বিরক্ত করবে না?
না। এই খনিটা মাটির অনেক নিচে, তামার আকরিকে বোঝাই। এখানে বাইরের পৃথিবীর কোনো সিগনাল আসে না। তোমার ট্রাকিওশানকে বাইরে থেকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। সে নিজে থেকে যদি দাঁড়াতে পারে তোমার অনুগত একটি ট্রাকিওশান হয়ে দাঁড়াবে।
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি। আমাকে যখন প্রথমবার হত্যা করা হয় তখন আমার মাথায় এ রকম ট্রাকিওশান ছিল।
আমি একটু শিউরে উঠে মেয়েটার দিকে তাকলাম, কী বলছে এই মেয়েটি? প্রথমবার হত্যা করার অর্থ কী?
একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না। একজন মানুষকে কি বারবার হত্যা করা যায়?
আমি মানুষ নই।
তুমি কী?
মেয়েটি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, প্রতিরক্ষা দপ্তরের একটি গোপন প্রজেক্ট ছিল, তার নাম প্রজেক্ট অতিমানবী। সেই প্রজেক্টে অনেক শিশু তৈরি করা হয়েছিল।
তৈরি করা হয়েছিল!
হ্যাঁ। ওরা কোনো মা–বাবার ভালবাসায় জন্ম নেয় নি। ওদেরকে ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছিল। সবাই ক্লোন। একটি কোষকে নিয়ে তার ডি. এন. এ.–কে একটু একটু করে পরিবর্তন করে নিখুঁত মানুষ তৈরি করার প্রজেক্ট ছিল সেটি। একসাথে তৈরি করা হত বিশ জন–পঁচিশ জন শিশু, প্রত্যেকটি শিশু ছিল এক জন আরেক জনের অবিকল প্রতিরূপ। একসাথে তাদের বড় করা হত একটি ইউনিট হিসেবে, তাদের আলাদা নাম দেওয়া হত না, আলাদা পরিচয় থাকত না। তারা সবাই মিলে একটি প্রাণী হিসেবে বড় হত। মানুষের শরীরে প্রত্যেকটি কোষ যেরকম আলাদা আলাদাভাবে জীবন্ত কিন্তু সবগুলো কোষ মিলে তৈরি হয় : মানুষ, অনেকটা সেরকম। প্রত্যেকটি শিশু আলাদা আলাদাভাবে জীবন্ত কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সবাই মিলে সত্যিকার একটা প্রাণী। একটা অতিমানব।
কোথায় সেইসব শিশুরা?
প্রতিরক্ষা দপ্তরের এই প্রজেক্ট ছিল পরীক্ষামূলক প্রজেক্ট। তাই এই শিশুদের জিনগুলোর মাঝে একটা বিধ্বংসী জিন ঢুকিয়ে দেওয়া হত। তাদের বয়স যখন হত পাঁচ বছর, বিধ্বংসী জিনটি তার কাজ শুরু করত। রক্তের লোহিত কণিকা তৈরি হত ভিন্নভাবে, অক্সিজেন নিতে পারত না। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে একে একে মারা যেত প্রতিটি শিশু হত্যা করার অনেক উপায় থাকা সত্ত্বেও এই নিষ্ঠুর উপায়টি বেছে নেওয়া হয়েছিল ইচ্ছে করে।