তরুণীটি কোনো কথা বলল না। বিচিত্র এক ধরনের বিষাদমাখা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
আমার মস্তিষ্কের মাঝে ইশি ফিসফিস করে বলল, হত্যা কর কিরি। হত্যা কর। এই চেহারা এই বিষাদমাখা চোখ সব বিভ্রম।
আমি ফিসফিস করে বললাম, বিভ্রম?
হ্যাঁ, বিভ্রম। ওর কোমল ত্বকের নিচে আছে টাইটেনিয়ামের দেহ। চোখের পিছনে সিলঝিনিয়াম ফটোসেল। বুকের ভিতরে নিউক্লিয়ার সেল।
সত্যি?
সত্যি। তুমি দেখলে না তোমার ভয়ঙ্কর আঘাতেও তার কিছু হয় নি? দেখছ না সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো মানুষ কি পারবে দাঁড়িয়ে থাকতে? পারবে?
না।
তা হলে হত্যা কর। সময় চলে যাচ্ছে কিরি।
অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়েটি তার বিষাদমাখা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ। হত্যা কর আমাকে। শুধু একটি কথা–
কী কথা?
আমাকে কথা দাও আমার মৃতদেহটি তুমি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে। এর প্রতিটি কোষকে। আমাকে কথা দাও।
আমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটি স্থির দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর নিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেলল। আমি দেখতে পেলাম তার চোখের কোনায় চিকচিক করছে পানি।
হত্যা কর কিরি। ইশি ফিসফিস করে বলল, হত্যা কর।
হ্যাঁ। হত্যা কর আমাকে। তরুণীটি বলল ফিসফিস করে।
না। আমি সোজা হয়ে দাঁড়ালাম, তার পর দুই পা পিছিয়ে এসে একটা পাথরের ওপর বসলাম। হঠাৎ করে আমার ক্লান্তি লাগতে থাকে। অমানবিক এক ধরনের ক্লান্তি, মৃত্যুর কাছাকাছি এক ধরনের ক্লান্তি।
মেয়েটি চোখ খুলে তাকাল। খানিকক্ষণ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কেন এখানে এসেছ?
আমি জোর করে চোখ খুলে রেখে মেয়েটির দিকে তাকালাম, কাঁপা কাঁপা ক্লান্ত গলায়। বললাম, তার আগে বল, তুমি কে? তুমি এখানে কেন এসেছ?
সেটা তো তুমি জান।
না, জানি না।
তা হলে কেন আমাকে হত্যা করতে চাইছ?
আমি চাইছি না। যারা আমাকে ব্যবহার করছে, তারা চাইছে।
মেয়েটি হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে আসে, উৎকণ্ঠিত গলায় বলে, তুমি অসুস্থ। কী হয়েছে তোমার?
আমার মাথায় একটা ট্রাকিওশান। শরীরে ক্ষেপণাস্ত্র। মুখের মাঝে বিস্ফোরক। আমার শরীরে উত্তেজক ড্রাগ। আমি কিছু খাই নি বহুদিন। আমি ঘুমাই নি বহুকাল।
মেয়েটি আমার কাছে এগিয়ে আসে, দুই হাতে আমাকে ধরে সাবধানে শুইয়ে দেয় নিচে। নিচু গলায় ফিসফিস করে বলে, বিশ্রাম নিতে হবে তোমার না–হলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হবে একটা আর্টারি ছিঁড়ে। যারা তোমাকে ব্যবহার করছে তোমার জন্য তাদের এতটুকু করুণা নেই।
আমি জানি।
তুমি ঘুমাও। আমি তোমাকে দেখে রাখব।
আমাকে দেখে রাখবে? আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, কিন্তু আমি তোমাকে হত্যা করতে এসেছিলাম।
কিছু আসে–যায় না তাতে। আমিও চাই একজন আমাকে হত্যা করুক। পূর্ণাঙ্গভাবে। হত্যা করুক। যেন
যেন কী?
মেয়েটা বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বলল, কিছু না। তুমি এখন ঘুমাও। ঘুমাও।
সত্যি সত্যি আমার চোখে হঠাৎ জলোচ্ছ্বাসের মতো ঘুম নেমে আসে। আমি অনেক কষ্ট করে চোখ খোলার চেষ্টা করে বললাম, তুমি কে?
মেয়েটা আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না।
জান না?
না। আমি কী আমি জানি কিন্তু আমি কে আমি জানি না।
গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে যাওয়ার আগে আমি শুনতে পেলাম ইশি ফিসফিস করে বলছে, হত্যা কর ওকে। হত্যা কর। মুখ থেকে ছুঁড়ে দাও বিস্ফোরক। ছুঁড়ে দাও।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না ইশি, আমি পারব না। আমি দানবকে ধ্বংস করতে পারি কিন্তু মানুষকে হত্যা করতে পারি না।
০৪. আমি ঠিক কত দিন
আমি ঠিক কত দিন বা কতক্ষণ গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে ছিলাম জানি না। ঘুমের মাঝে বিকারগ্রস্ত মানুষের মতো আমি অর্থহীন স্বপ্ন দেখতে থাকি। মনে হতে থাকে আমার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জীবন্ত প্রাণীর মতো কিলবিল করে নড়ছে, আমি গড়িয়ে গড়িয়ে একটি অন্ধকার অতল গহ্বরে পড়ে যাচ্ছি। সেই অতল গহ্বরে মহাজাগতিক বীভৎস কিছু প্রাণী আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমার দেহকে তারা চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে খেতে এগিয়ে আসছে। প্রচণ্ড আতঙ্কে আর অমানুষিক যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করতে থাকি আর তার মাঝে কোনো এক নারীকণ্ঠ আমাকে কোমল গলায় ডাকতে থাকে।
আমি ঘুম ভেঙে একসময় জেগে উঠি, দেখি সত্যি সত্যি অপূর্ব রূপবতী একটি মেয়ে আমাকে ডাকছে। আমার মনে হতে থাকে এটি বুঝি পৃথিবীর কোনো মানবী নয়, যেন স্বর্গ থেকে কেউ ভুল করে নেমে এসেছে। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার হঠাৎ সব কথা মনে পড়ে গেল, আমি এই অপূর্ব রূপবতী মেয়েটিকে হত্যা করতে এসেছিলাম।
মেয়েটি কোমল গলায় বলল, তুমি ঘুমের মাঝে কোনো একটি দুঃস্বপ্ন দেখছিলে।
হ্যাঁ। স্বপ্ন দেখছিলাম বীভৎস কোনো প্রাণী আমাকে খেয়ে ফেলছে। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন।
জানি। দুঃস্বপ্ন খুব ভয়ঙ্কর হয়। আমি জেগে জেগেও দুঃস্বপ্ন দেখি।
আমি মেয়েটার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকালাম, জিজ্ঞেস করলাম, কী বললে?
মেয়েটি একটা নিঃশ্বাস ফেলল, বলল, না। কিছু না।
আমি উঠে বসে বললাম, তোমার সাথে আমার এখনো পরিচয় হয় নি। আমার নাম কিরি।
তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম কিরি।
তোমার নাম?
আমার কোনো নাম নেই।
আমি অবাক হয়ে বললাম, নাম নেই? কী বলছ?