বেশ।
যদি তুমি বেঁচে থাক তোমাকে অভিনন্দন জানাব। যদি বেঁচে না থাক তা হলে বিদায় নিয়ে নিচ্ছি।
ঠিক আছে।
যদি কিছু অন্যায় করে থাকি, না বুঝে তোমার মনে কোনোরকম আঘাত দিয়ে থাকি তার জন্য ক্ষমা চাইছি।
ক্ষমা চাইবার কোনো প্রয়োজন নেই।
ইশি হঠাৎ করে পুরোপুরি নিঃশব্দ হয়ে গেল। সুড়ঙ্গের একেবারে শেষ মাথায় একটা গুহার মতো জায়গা, একপাশে খোলা অংশটুকু দরজার মতো, মনে হয় ভিতরে একটা ঘর। সেই ঘরে কী আছে আমি জানি না, রোবটটিকে যদি বের হতে হয় এই দরজা দিয়ে বের হতে হবে। আমি দুই হাতে শক্ত করে এটমিক রাস্তারটা ধরে হাত উঁচু করে রেখে নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে থাকি, যত কাছে যেতে পারব লক্ষ্যভেদের সম্ভাবনা তত বেড়ে যাবে। আমি বুঝতে পারি আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে, আমি জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম।
হঠাৎ খুট করে অস্পষ্ট একটা শব্দ হল সাথে সাথে সামনে দরজার মতো খোলা জায়গায় যেন অদৃশ্য থেকে একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল। আমি এক মুহূর্তের জন্য চমকে উঠলাম, ছায়ামূর্তিটি হুবহু মানুষের ছায়ামূর্তি। আলোটা পিছন থেকে আসছে বলে আমি চেহারা, দেহের অবয়ব দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু মনে হল এটি একটি নারী। প্রতিরক্ষা দপ্তর আমাকে বলেছিল এটি একটি নারীদেহ ধারণ করে আছে। আমি নিশ্বাস আটকে রেখে এটমিক ব্লাস্টারের ট্রিগার টেনে ধরলাম, তীব্র একটা আলোর ঝলকানির সাথে সাথে তীক্ষ্ণ একটি শব্দ হল। সাথে সাথে ছায়ামূর্তিটিসহ গুহার বিশাল অংশটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধসে পড়ল। ধুলোয় ঢেকে গেল চারদিক। আমি তার মাঝে জোর করে এটমিক ব্লাস্টার হাতে চোখ খোলা রেখে দাঁড়িয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণের মাঝেই বিস্ফোরণের ঝাঁপটা কমে আসে, গড়িয়ে পাড়া পাথর ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ে স্থির হয়ে আসে, ধুলোর আস্তরণ সরে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে থাকি, ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছায়ামূর্তিটিকে নিজের চোখে দেখে নিশ্চিত হতে হবে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে দরজার মুখটা প্রায় বুজে গিয়েছে, সাবধানে গুঁড়ি মেরে ভিতরে ঢুকলাম, বিস্ফোরকের একটা ঝাঁজালো গন্ধ ভিতরে। বড় বড় কয়েকটা পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে আমি খোলা মতন একটা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম, তীব্র একটা আলো জ্বলছে মাথার উপরে, এই কর্কশ আলোতে পুরো এলাকাটাকে কী ভয়ানক শ্রীহীন, কী নিদারুণ বিষাদময় দেখায়! আমি মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাতে গিয়ে হঠাৎ করে থেমে গেলাম। ঠিক আমার। পিছনে, শোনা যায় না এ রকম একটা মৃদু শব্দ হয়েছে, আমার পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে আমার মস্তিষ্ক ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার জন্য একমুহর্ত অপেক্ষা করলাম কিন্তু কিছু হল না। মেয়ের গলায় কেউ খুব মৃদু স্বরে বলল, যেভাবে দাঁড়িয়ে আছ ঠিক সেভাবে দাঁড়িয়ে থাক। একটু নড়লেই তোমাকে আমি হত্যা করব নিশ্চিত জেনো।
আমি সাবধানে বুকের ভিতর থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দিলাম। আধা জৈবিক যে প্রাণীটি মেয়ের অবয়ব নিয়ে আমার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে সেটি আমাকে সাথে সাথে হত্যা করে একটি খুব বড় ভুল করেছে। আমি বেঁচে থাকব কি না জানি না, কিন্তু এই প্রাণীটি নিশ্চিতভাবে ধ্বংস হবে আজ।
মেয়ের গলায় আধা জৈবিক প্রাণীটি আবার কথা বলল, আমি আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত তুমি এতটুকু নড়বে না। কথা বলবে না।
আমি নড়লাম না, কথা বললাম না, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়ের গলায় আবার প্রাণীটি কথা বলল, তোমার হাতের অস্ত্রটি নিচে ফেলে দাও।
আমি এটমিক ব্লাস্টারটি নিচে ফেলে দিলাম।
এবারে এক পা সামনে এগিয়ে যাও।
আমি ছোট একটি পদক্ষেপ ফেলে অল্প একটু সামনে এগিয়ে গেলাম। প্রাণীটিকে আমি নিরস্ত্র দেখছিলাম, সে সম্ভবত এই অস্ত্রটি তুলে নেবে। অস্ত্রটি তোলার জন্য তাকে নিচু হতে হবে। মানুষ রোবট বা আধা জৈবিক যে কোনো প্রাণীই নিচু হওয়ামাত্রই খানিকটা অসহায় হয়ে যায়। তখন তাকে আক্রমণ করতে হবে।
আরো এক পা এগিয়ে যাও।
আমি আবার তুলনামূলকভাবে ছোট একটি পদক্ষেপ ফেলে অল্প একটু এগিয়ে গেলাম। আমি আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সজাগ রেখে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাণীটির গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করতে থাকি। অস্পষ্ট একটা শব্দ পোশাকের খসখসে একটা কম্পন শুনেই আমি হঠাৎ বিদ্যুদ্বেগে শূন্যে লাফিয়ে উঠে ঘুরে গেলাম। পায়ের শক্ত আঘাতে পিছনের প্রাণীটি তাল হারিয়ে ফেলল। নিচে নামার আগেই আমি আমার সমস্ত শরীর দিয়ে প্রাণীটিকে দ্বিতীয়বার আঘাত করলাম। কাতর একটা ধ্বনি করে প্রাণীটি শক্ত পাথরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
আমি দুই পায়ের ওপর ভর দিয়ে প্রায় একটা ক্ষেপণাস্ত্রের মতো প্রাণীটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। হাতটি তার দেহ থেকে একটু সামনে স্থির রেখে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরকটি দিয়ে আঘাত করতে গিয়ে থেমে গেলাম। প্রাণীটি স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এটি আধা জৈবিক কোনো প্রাণী নয়, এটি কুশলী কোনো রোবট নয়, এটি অনিন্দ্যসুন্দরী একটি তরুণী। তরুণীটির মুখে কোনো ভয় নেই, কোনো আতঙ্ক বা হতাশা নেই, এক গভীর বিষাদে সেটি ঢেকে আছে।
আমি আমার হাতের মাঝে লুকিয়ে রাখা ভয়ঙ্কর অস্ত্রটি তার মাথার কাছে ধরে রেখে বললাম, তুমি কে?