গ্লাইডারের দরজা খুলে আমি বের হয়ে এলাম, চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সুইচ টিপে ইনফ্রারেড চশমাটি চালু করে দিতেই মনে হল চারদিকে এক ধরনের অশরীরী আলো ছড়িয়ে পড়েছে। পরিত্যক্ত এই খনিটির কোথায় সেই আধা জৈবিক রোবটটি লুকিয়ে আছে আমি জানি না। আমি সেটিকে খুঁজে পাব, নাকি সেটিই আমাকে খুঁজে বের করে, সে কথাটিই–বা কে বলতে পারে!
খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে নাও কিরি। ইশির কথা শুনে আমার খাবারের প্যাকেটটির কথা মনে পড়ল, এই নির্জন এলাকায় আমাকে কতদিন একাকী থাকতে হবে কে জানে, যে খাবারের প্যাকেটটি দেওয়া হয়েছে সেটি দেখে মনে হচ্ছে এক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে।
খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে আমি হাঁটতে থাকি। খানিকদূর হেঁটে যেতেই খনির গভীরে নেমে যাওয়া সুড়ঙ্গটি চোখে পড়ল। প্রাচীনকালে আকরিক খনিজ তোলার জন্য অত্যন্ত অবিবেচকের মতো পৃথিবীর নিচে অনেক গহ্বর খোঁড়া হয়েছিল, তার বিশাল এলাকা এখন। বিপজ্জনক বলে পরিত্যক্ত হয়েছে। এটি সম্ভবত সেরকম একটি এলাকা। আমি সুড়ঙ্গের মুখে এসে দাঁড়াতেই ইশি ফিসফিস করে বলল, তোমার এদিক দিয়ে নামতে হবে।
আমি সুড়ঙ্গের গভীরে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেললাম, এর ভিতরে আমার জন্য কী লুকিয়ে আছে কে জানে! আমি ব্যাগ খুলে একটা পলিলন কর্ড বের করে সুড়ঙ্গে নামার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। কর্ডটা একটা আংটা দিয়ে উপরে আটকে নিয়ে নিচে তাকালাম, ইনফ্রারেড চশমায় অত্যন্ত বিচিত্র দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে পরাবাস্তব একটি জগৎ আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমি যেটুকু সম্ভব নিঃশব্দে নিচে নেমে আসতে থাকি। আধা জৈবিক রোবটটি গোপনে কোনো সুড়ঙ্গ থেকে আমাকে ধ্বংস করে দিলে এই মুহূর্তে আমার কিছু করার নেই।
নিঃশব্দে নেমে আসার চেষ্টা করেছি বলে দীর্ঘ সময় লেগে গেল। পায়ের নিচে শক্ত মাটি অনুভব করার পর আমি বুক থেকে একটি নিশ্বাস বের করে সাবধানে শক্ত পাথরের দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পিছন থেকে আচমকা কেউ আর আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে না।
আমি নিঃশব্দে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে জায়গাটা সম্পর্কে একটা ধারণা করার চেষ্টা করতে থাকি। একটি গভীর সুড়ঙ্গ ডান দিকে নেমে গেছে। কোথাও আলোর কোনো চিহ্ন নেই, নিকষ কালো অন্ধকার–ইনফ্রারেড চশমায় সেটিকে একটি অলৌকিক জগতের মতো দেখাতে থাকে।
ইশি ফিসফিস করে বলল, এখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়। তুমি এগিয়ে যাও।
আমি ডান হাতে অস্ত্রটি ধরে রেখে সাবধানে এগুতে থাকি। আজ থেকে হাজারখানেক বছর আগে পৃথিবীর মানুষ এই খনির ভিতর থেকে লোহার আকরিক তুলে নিয়ে গেছে। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে সুড়ঙ্গের মুখ জায়গায় জায়গায় বুজে গিয়েছে। আমি কোথাও হেঁটে হেঁটে, কোথাও গুঁড়ি মেরে, কোথাও প্রায় গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যেতে থাকি। চামড়ার নিচে সিরিঞ্জ দিয়ে যে বায়োকেমিক্যালটি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটি আমার রক্তের মাঝে বিচিত্র সব হরমোন মিশিয়ে দিচ্ছে। আমার চোখে তাই কোনো ঘুম নেই, আমি এখন হিংস্র শ্বাপদের মতো সজাগ, আমার দেহ চিতাবাঘের মতো ক্ষিপ্র, আমার স্নায়ু ধনুকের ছিলার মতো টানটান। আমার সমস্ত মনোযোগ এখন এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে, কোনো একটি চলন্ত ছায়া, জীবনের কোনো একটি স্পন্দন দেখামাত্রই তাকে ধ্বংস করে দিতে হবে। যদি তা না করা হয় সেই ভয়ঙ্কর আধা জৈবিক প্রাণী আমাকে ধ্বংস করে দেবে।
.
এভাবে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন পরিত্যক্ত একটি খনির সুড়ঙ্গে ঘুরে বেড়াতে থাকি। কতদিন পার হয়েছে কে জানে। প্রথমে ক্ষুধার সময় প্যাকেট খুলে কিছু খেয়েছিলাম। খাবারের মাঝে কী ছিল আমি জানি না, এখন আর আমার মাঝে ক্ষুধা–তৃষ্ণা নেই। আমার চোখে ঘুম নেই, দেহে ক্লান্তি নেই। আমার বুকের ভিতরে এখন কোনো অনুভূতি নেই, নিজেকে বোধশক্তিহীন একটা যন্ত্রের মতো মনে হয়। যে অদৃশ্য আধা জৈবিক রোবটটিকে আমার ধ্বংস করতে হবে তার বিরুদ্ধে আমার কোনো ক্ষোভ নেই, কোনো ক্রোধ বা জিঘাংসা নেই কিন্তু তবু আমি জানি তাকে আমার ধ্বংস করতে হবে।
আমার ভিতরে ধীরে ধীরে এক ধরনের অস্থিরতার জন্ম হতে থাকে, নিকষ কালো অন্ধকারে ইনফ্রারেড চশমার বিচিত্র আধিভৌতিক এক জগতে হেঁটে হেঁটে নিজেকে একটি পরাবাস্তব জগতের অধিবাসী বলে মনে হয়। পুরো ব্যাপারটিকে মনে হয় ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত বিকারগ্রস্ত কোনো মানুষের দুঃস্বপ্ন। আমি ধীরে ধীরে অনুভব করতে থাকি আমার অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। যে নৃশংস কাজের জন্য আমাকে প্রস্তুত করা হয়েছে সেটি শেষ করার জন্য নিজের ভিতরে এক ধরনের অতিমানবিক তাগিদ অনুভব করতে থাকি। যখন এই অস্থিরতা এই অতিমানবিক তাড়না অসহ্য হয়ে উঠল ঠিক তখন আমি সুড়ঙ্গের গভীরে বহুদূরে একটা শীর্ণ আলোকরশ্মি দেখতে পেলাম। আমি স্পেকট্রাম এনালাইজারে পরীক্ষা করে দেখলাম, সত্যিই সেটা আলোকরশ্মি, তরঙ্গদৈর্ঘ্য মানুষের ঠিক দৃষ্টিসীমার ভিতরে।
ইশি আমার মস্তিষ্কের ভিতরে ফিসফিস করে বলল, সাবধান কিরি।
আমি সাবধান আছি।
মনে রেখো তুমি কিন্তু দ্বিতীয় সুযোগ পাবে না।
মনে রাখব।
আমি পুরোপুরি নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছি কিরি। তোমার একাগ্রতায় যেন এতটুকু ক্রটি না হয় সে জন্য আমি এতটুকু শব্দ করব না।