আমি অন্ধকার কালো দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে থাকি, ইনফ্রারেড চশমায় সমস্ত এলাকাটাকে একটা কাল্পনিক ভুতুড়ে দৃশ্যের মতো মনে হয়। ঘরের দেয়াল, পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি থেকে বিচিত্র তাপমাত্রা বিকিরণ করছে, তার মাঝে আমি একটি নিষ্ঠুর আধা জৈবিক যন্ত্র খুঁজতে থাকি।
আমি ছোট একটি ধসে যাওয়া ঘর থেকে বড় একটা হলঘরে এসে হাজির হলাম। শোধনাগারের বড় বড় পাইপ, উঁচু ডিস্টিলেশান কলাম, ধ্বংস হয়ে যাওয়া যন্ত্রপাতি এবং জঞ্জালের মাঝে সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ আমার সামনে দিয়ে দ্রুত কিছু একটা ছুটে গেল। আমি সাথে সাথে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। বড় একটি ট্যাংকের সাথে পিঠ লাগিয়ে আমি নিঃশব্দে হাতে এটমিক ব্লাস্টারটি তুলে নিই। যে প্রাণী বা যন্ত্রটি আমার সামনে দিয়ে ছুটে গেছে তার আকার মানুষের মতো, মাথার অংশটি ইনফ্রারেড চশমায় স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে, যার অর্থ সেটি উত্তপ্ত, একটি রোবটের যেরকম থাকার কথা। যে গতিতে ছুটে গেছে সেটি একজন মানুষের মতোই, নিশ্চিতভাবে কোনো এক জায়গায় সেটি লুকিয়ে গেছে, আমি তাকে দেখে যেটুকু সতর্ক হয়েছি, সেটিও নিশ্চয়ই আমাকে দেখে ততটুকু সতর্ক হয়েছে।
শব্দ প্রসেসরে আমি হঠাৎ মৃদু একটা শব্দ শুনতে পেলাম, তার কয়েক মুহূর্ত পরে আরেকটি। এই যন্ত্র বা প্রাণীটি গুড়ি মেরে আমার দিকে গিয়ে আসছে। আমি নিঃশব্দে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, নড়ামাত্রই মনে হয় সেটি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি প্রাণীটিকে আমার আরেকটু কাছে এগিয়ে আসতে দিলাম তারপর বিদ্যুদ্বেগে ঘুরে গিয়ে প্রায় শূন্যে লাফিয়ে উঠে প্রাণীটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। প্রাণীটি আমার এ রকম আচরণের জন্য প্রস্তুত ছিল না, আমার পায়ের ধাতব জুতোর আঘাতে কিছু–একটা ঝনঝন করে ভেঙে গেল। এবং আমি কয়েকটা বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ ছুটে যেতে দেখলাম।
আমি যখন আবার নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়েছি তখন আমার দুই হাতে শক্ত করে ধরে রাখা এটমিক ব্লাস্টারটি প্রাণীটির কণ্ঠনালীতে ধরে রাখা, প্রাণীটিকে আমি ঠেলে দিয়েছি সামনের দিকে, ভরকেন্দ্র সরে গিয়েছে সামনে, আর একটু ধাক্কা দিলেই সে তাল হারিয়ে নিচে পড়বে। আমি হিংস্র গলায় চিৎকার করে বললাম, খবরদার, একটু নড়লেই তোমার কপোট্রন উড়িয়ে দেব।
রোবট বা প্রাণীটি নড়ার চেষ্টা করল না, ট্রিগারে হাত রেখে বললাম, তুমি কে? এখানে কেন এসেছ?
রোবটটি উত্তর দেবার আগেই ইশি ফিসফিস করে বলল, ছেড়ে দাও ওকে।
ছেড়ে দেব?
হ্যাঁ, এই মাত্র প্রতিরক্ষা দপ্তর খবর পাঠিয়েছে পুরো ব্যাপারটি একটি রিহার্সাল। এটা একটা সাজানো ঘটনা।
সাজানো?
আমার কথা শেষ হবার আগেই উজ্জ্বল আলোতে চারদিক প্লাবিত হয়ে গেল। অন্ধকারে এতক্ষণ রেটিনার রডগুলো কাজ করছিল হঠাৎ করে উজ্জ্বল আলোতে চোখ ধাধিয়ে গেল। চোখে আরো সয়ে যেতেই দেখলাম যে–ঘরটিকে পরিত্যক্ত জ্বালানি শোধনাগার ভেবেছিলাম সেটি অনেক যত্ন করে তৈরি করা একটি থিয়েটারের স্টেজের মতো। অসংখ্য ক্যামেরা আমার দিকে তাক করে আছে। আমার হঠাৎ নিজেকে নির্বোধের মতো মনে হতে থাকে।
আমি রোবটটিকে একটা ছোট ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিলাম। সেটি কয়েক পা ছুটে তাল সামলে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি ক্রুদ্ধ গলায় বললাম এর অর্থ কী?
ইশি অপরাধীর মতো বলল, আমিও জানতাম না। প্রতিরক্ষা দপ্তর দেখতে চাইছিল সত্যিকারের পরিস্থিতিতে তুমি কী রকম ব্যবহার কর।
দেখেছে?
নিশ্চয়ই দেখেছে।
এটমিক ব্লাস্টার দিয়ে গুলি করে কিছু–একটা উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল, অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে বললাম, এ রকম আর কতবার রিহার্সাল হবে?
আর হবে না।
তুমি নিশ্চিত?
আমি নিশ্চিত। তোমার আর রিহার্সালের প্রয়োজন নেই।
.
এক সপ্তাহ পরে মধ্যরাতে ইশি আবার আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল, বলল, কিরি প্রস্তুত হও।
আমি মুহর্তে পুরোপুরি জেগে উঠলাম, বললাম, পাওয়া গেছে?
হ্যাঁ। উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চলে একটা পরিত্যক্ত খনিতে লুকিয়ে আছে সে। আগেই খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল, একটু আগে নিঃসন্দেহ হগেছে। তুমি প্রস্তুত হয়ে নাও।
কত দূর এখান থেকে?
কমপক্ষে তিন শ কিলোমিটার। প্রক্রিক্ষাবাহিনীর বিশেষ জেট বিমানে যাবে তুমি। বেশি সময় লাগার কথা নয়।
আমি আবার নিজেকে নিও পলিমারের আস্তরণে ঢেকে নিলাম, ছোট একটা ব্যাগে এটমিক ব্লাস্টারটি ভরে নিয়ে আবার সারা শরীরের নানা যন্ত্রাংশকে চালু করতে শুরু করলাম। রক্তে বিচিত্র সব হরমোন মিশিয়ে দেবার জন্য চামড়ার নিচে সিরিঞ্জ দিয়ে উত্তেজক ড্রাগগুলো প্রবেশ করিয়ে দিলাম। ইনফ্রারেড চশমার নিয়ন্ত্রণটুকু পরীক্ষা করে নিয়ে বললাম, চল ইশি যাই।
ঘরের বাইরে অন্ধকারে আমার জন্য ছোট একটি ভাসমান যান অপেক্ষা করছিল। আমাকে নিয়ে সেটি কিছুক্ষণের মাঝেই শহরের কেন্দ্রস্থলের বিমানবন্দরে পৌঁছে দিল। সেখানে ছোট একটি জেট বিমানে করে আমাকে রাতের অন্ধকারে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল। পাহাড়ি অঞ্চলের নির্জন পরিত্যক্ত একটি খনির উপরে আমাকে ছোট গ্লাইডারে নামিয়ে দেওয়া হল। তিন কিলোমিটার উঁচু থেকে সেই স্বেচ্ছানিয়ন্ত্রিত গ্লাইডার নিঃশব্দে নিচে নেমে এল।