তরুণটি সুইচের কোনো এক জায়গায় স্পর্শ করামাত্র কদাকার যন্ত্রটি অনিন্দ্যসুন্দর একজন কিশোরের রূপ নিয়ে নিল।
কিংবা এই রূপে– কিশোরটি একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষে পরিণত হল, উঁচু চোয়াল, গভীর বিষণ্ণ নীল চোখ এবং একমাথা কোঁকড়ানো চুল।
আমাদের শেষ তথ্য অনুযায়ী যন্ত্রটি ইদানীং একটি মেয়ে রূপ গ্রহণ করছে। তার চেহারা সম্ভবত এ রকম।
হলোগ্রাফিক ছবিটি একটি স্বল্পবসনা রূপবতী মেয়ের রূপ গ্রহণ করে। আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে এই অপূর্ব রূপবতী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি তার প্রাণহীন একঘেয়ে গলায় আবার কথা বলতে শুরু করে, এই যন্ত্রটি বাইরে যে রূপ নিয়েই থাকুক না কেন, তার ভিতরে রয়েছে অসম্ভব জটিল কিছু যান্ত্রিক কলকব্জা। দেশের একটি আন্তর্জাতিক অপরাধী সংস্থা কিছু নীতিহীন বিজ্ঞানীদের দিয়ে এই আধা যান্ত্রিক জৈবিক রোবটটিকে তৈরি করেছে। তার কপোট্রনের মেমোরি প্রায় মানুষের কাছাকাছি, চিন্তা করার ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। তার শারীরিক ক্ষমতা মানুষ থেকে অনেকগুণ বেশি। সাধারণ রোবট কোনো একটি বিষয়ে পারদর্শী হয়, এই আধা জৈবিক রোবটটি প্রায় সব বিষয়ে পারদর্শী। তার প্রধান শক্তি হচ্ছে অমানুষিক নিষ্ঠুরতা। মানুষের প্রতি এক বিচিত্র ঘৃণা তার ভিতরে অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে। সেই ঘৃণা যে কী ভয়ঙ্কর আমরা এখনই তার একটা প্রমাণ দেখাব।
ঘরের মাঝামাঝি হলোগ্রাফিক ছবিটি পাল্টে গিয়ে সেখানে হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর কিছু দৃশ্য দেখানো শুরু হয়। প্রতিরক্ষা দপ্তরের এজেন্টদের শরীরে লাগানো ক্যামেরা থেকে তোলা কিছু ছবির পুনর্গঠন। ছবিগুলো স্পষ্ট কিংবা পূর্ণাঙ্গ নয়, ঘটনার বীভৎসতা সে কারণে মনে হয় আরো ঠিকভাবে ধরা পড়েছে। যে দৃশ্যগুলো দেখানো হচ্ছে সেগুলো সত্যি ঘটেছে চিন্তা করে আমার সমস্ত শরীরে কাটা দিয়ে ওঠে।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, এই অস্বাভাবিক আধা জৈবিক বরাবটের সাথে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করা খুব সহজ নয়। আমাদের চার জন এজেন্ট ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। সম্ভবত তুমিও প্রাণ হারাবে। কিন্তু আমাদের চেষ্টা করেই যেতে হবে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি, তার ওপর ভিত্তি করে তোমাকে প্রস্তুত করা হয়েছে। এই আধা জৈবিক রোবটটির কাছাকাছি তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তখন হয় সে তোমাকে হত্যা করবে, না হয় তুমি তাকে হত্যা করবে।
আমি চুপচাপ বসে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এই ধরনের ভয়ঙ্কর একটা জীবন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল কে জানত?
০৩. প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে সশস্ত্র হয়ে
প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে সশস্ত্র হয়ে ফিরে আসার পর আমার জীবনধারা অনেকখানি পাল্টে গেল। আমি একমুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারলাম না যে, আমার শরীরের নানা জায়গায় ভয়ঙ্কর কিছু অস্ত্র জুড়ে দেওয়া হয়েছে। অঙ্গুলি হেলনে আমি বিশাল অট্টালিকা ধুলো করে দিতে পারি, এক ছুঁয়ে আক্ষরিক অর্থে আমি একটা ছোট জনপদ ধ্বংস করে দিতে পারি। আমাকে ব্যবহার করার জন্য যে এটমিক ব্লাস্টার দেওয়া হয়েছে সেটা ব্যবহার করে আমি অবলীলায় এক মিটার পুরু সীসার পাতে দশ সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের গর্ত করে ফেলতে পারি। আমার এই অমানবিক ক্ষমতা আমার মাঝে এতটুকু আনন্দ নিয়ে এল না, নিজেকে সবসময় এক ধরনের হিংস্র দানব মনে হতে লাগল। যে ভয়ঙ্কর আধা জৈবিক রোবটটির মুখোমুখি হবার জন্য আমাকে এই হিংস্র দানবে পরিণত করা হয়েছে সেই রোবটটির প্রতি আমার ভিতরে এক বিজাতীয় ঘৃণার জন্ম হতে থাকে। এই রোবট বা প্রাণীটিকে দেখামাত্রই আমি যে তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারব আমার ভিতরে সেটা নিয়ে এতটুকু সন্দেহ ছিল না। এই ধরনের অনুভূতির সাথে আমি পরিচিত নই, বুকের ভিতরে ভয়ঙ্কর জিঘাংসা নিয়ে বেঁচে থাকা অত্যন্ত কষ্টকর। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই আধা জৈবিক রোবটটির মুখোমুখি হবার। জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এই সম্মুখ সংঘর্ষে আমি রোবটটিকে হত্যা করব নাকি রোবটটা আমাকে হত্যা করবে আমি জানি না, কিন্তু এখন তাতে কিছুই আসে–যায় না। পুরো ব্যাপারটির অবসান ঘটানো ছাড়া এই মুহূর্তে আমি আর অন্য কিছুই চিন্তা করতে পারছি না।
কাজেই একদিন মধ্যরাতে যখন ইশি আমাকে ডেকে তুলে বলল, কিরি প্রস্তুত হও তখন আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের অসুস্থ্ উল্লাস অনুভব করতে শুরু করলাম। আমি নিও পলিমারের আবরণে নিজেকে ঢেকে নিলাম, ছোট একটি ব্যাগে এটমিক ব্লাস্টারটি ভরে নিয়ে শরীরের নানা যন্ত্রাংশকে চালু করতে শুরু করলাম। সিরিঞ্জ দিয়ে চামড়ার নিচে একটি ছোট উত্তেজক ড্রাগ প্রবেশ করিয়ে দিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিলাম।
মধ্যরাতে ইশি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করল। শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে বহু দূরে একটি পরিত্যক্ত জ্বালানি পরিশোধনাগারে আমাকে নামিয়ে দেওয়া হল। এলাকাটি নির্জন এবং অন্ধকার। আমাকে ইনফ্রারেড চশমা ব্যবহার করে অন্ধকারে হেঁটে যেতে হল। আমার হাতে শক্তিশালী এটমিক ব্লাস্টার, আমার শরীরে একাধিক ভয়ঙ্কর অস্ত্র, আমার রক্তে বিচিত্র কিছু হরমোন আমাকে বাড়াবাড়ি সাহসী করে রেখেছে কিন্তু তবুও আমার বুকের ভিতরে কোনো এক জায়গায় একটি বিচিত্র ধরনের আতঙ্ক কাজ করতে লাগল। আমি ইনফ্রারেড চশমায় অন্ধকারে গুঁড়ি মেরে থাকা আধা জৈবিক ভয়ঙ্কর রোবটটি খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে যেতে থাকি। রোবটটির তাপমাত্রা কত হবে আমি জানি না, কপোট্রনে নিশ্চিতভাবে কিছু বেশি উত্তাপ থাকার কথা, আমার এই ইনফ্রারেড চশমায় নিশ্চয়ই আমি তাকে দেখতে পাব। সংবেদনশীল শব্দ প্রসেসরটিও চালু করেছি, সোজাসুজি সেটি শোনার কোনো উপায়। নেই, বিল্ডিঙের অন্য প্রান্তে ছোট মাকড়সার দেয়াল বেয়ে হেঁটে যাওয়ার শব্দটি পর্যন্ত শুনতে পাওয়া যায়, তার মাঝে কোনটি সন্দেহজনক শব্দ এবং সেটি কোনদিক দিয়ে আসছে বোঝা কঠিন। শব্দ প্রসেসরের শক্তিশালী কম্পিউটারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রোগ্রামটি সেটি প্রতিনিয়ত বিশ্লেষণ করে সন্দেহজনক শব্দগুলোর অস্তিত্ব আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল। পরিত্যক্ত এই জ্বালানি পরিশোধনাগারে ঢোকার আগে পর্যন্ত ইশি আমার সাথে কথা বলছিল, কিন্তু তারপর হঠাৎ করে নিঃশব্দ হয়ে গেছে। আমার পরিপূর্ণ মনোযোগে সে এতটুকু বিচ্যুতি ঘটাতে চায় না।