তার মানে তুমি আমাকে বলবে না।
আমি কোনো কথা না বলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। আকাশে চমৎকার মেঘ করেছে। দূরে বনাঞ্চলে ঝড়ো হাওয়া দিচ্ছে, গাছের পাতা নড়ছে বাতাসের ঝাপটায়। কী চমৎকার লাগছে দেখতে! জানালার এই দৃশ্যটি কৃত্রিম তবু সেটিকে সত্যি বলে ভাবতে ভালো লাগে।
চতুর্থ দিন ভোরবেলা আমি কাজে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন আমার মস্তিষ্কের ভিতর থেকে ইশি বলল, কিরি, তোমার আজকে কাজে যাবার প্রয়োজন নেই।
কেন?
তোমাকে আজ প্রতিরক্ষা দপ্তরে যেতে হবে।
প্রতিরক্ষা দপ্তরে?
হ্যাঁ। তোমাকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র চালনা শেখানো হবে। কোথায় যেতে হবে কী করতে হবে সে সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হবে।
আমি যদি যেতে না চাই?
কেন চাইবে না? ইশি হাসির মতো একটা শব্দ করে বলল, তোমার জন্য পুরো ব্যাপারটি হবে আশ্চর্য রকম সহজ।
আমি কোনো কথা না বলে একটা নিশ্বাস ফেললাম।
.
প্রতিরক্ষা দপ্তরের অফিসটিকে বাইরে থেকে চেনার কোনো উপায় নেই। ইশি আমাকে না বলে দিলে আমি কোনোদিন সেখানে প্রবেশ করতাম না। বড় কালো দরজার পিছনেই কয়েকজন মানুষ অপেক্ষা করছিল, একজন এগিয়ে এসে আমার সাথে হাত মিলিয়ে বলল, আমার নাম বর্কেন। এটা অবশ্য আমার সত্যিকারের নাম নয়। আজকের জন্য আমার নাম বকেন।
আমি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, তোমার সত্যিকারের নাম বললে ক্ষতি কী?
নিষেধ রয়েছে। এখানে এটা তৃতীয় মাত্রার অপরাধ।
ও।
আমার সাথে আছে দুই জন, কুন্না এবং ত্রালুস।
এগুলোও কি বানানো নাম?
হ্যাঁ।
তোমরা কি সবাই রোবট?
মানুষটা হঠাৎ থতমত খেয়ে গেল, নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু–একটা বলতে যাচ্ছিল আমি হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তুমি রোবট কি না তাতে কিছু আসে–যায় না। আমার মাথায় একটা ট্রাকিওশান আছে সেটা আমাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমারও নিজেকে রোবট বলে মনে হয়। পুরোপুরি রোবট হয়ে গেলে খারাপ হয় না।
বৰ্কেন নামের মানুষটা মুখে বিচিত্র একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, বেশ ভালোই হল তা হলে। আমাদের কাজ শেষ হলে তুমি মোটামুটিভাবে পুরোপুরি রোবটই হয়ে যাবে।
আমি চমকে উঠে মানুষটার দিকে তাকালাম, তার চোখে কৌতুকের কোনো চিহ্ন নেই।
.
ইশি যখন আমাকে বলেছিল প্রতিরক্ষা দপ্তরে আমাকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র চালানো শেখানো হবে আমার ধারণা ছিল সেগুলো হবে সনাতনধর্মী অস্ত্র, লেজার রশ্মিচালিত বিস্ফোরক বা এই ধরনের কিছু। কিন্তু প্রতিরক্ষা দপ্তরের মানুষেরা তার ধারেকাছে দিয়ে গেল না। তারা আমার ডান হাতের তর্জনী কেটে সেখানে ছোট একটি টিউব বসিয়ে দিল, তার পিছনে প্রক্ষেপণের জন্য যে যান্ত্রিক অংশটুকু রয়েছে সেটিকে আঙুলের নার্ভের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমি তর্জনী টানটান করে সেই যান্ত্রিক অংশটুকু চালু করতে পারি। সাথে সাথে ভয়াবহ টিউবের ভিতর দিয়ে ছুটে যাবে শক্তিশালী বিস্ফোরক। সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত একটি শত্রু ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে একমুহূর্তে।
আমার মুখের ভিতরে, জিভের নিচে বসানো হল দ্বিতীয় অস্ত্রটি, দাঁতের সাথে শক্ত করে আটকানো হয়েছে সেটি। ফুঁ দেওয়ার ভঙ্গিতে সেটাকে চালু করে তার যান্ত্রিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে মুহূর্তে ছুঁড়ে দেওয়া যাবে ভয়ঙ্কর এক বিস্ফোরক।
সবশেষে অবশ্য আমাকে কিছু পরিচিত অস্ত্রও দেওয়া হল। তার ব্যবহারও শেখানো হল। দুই কিলোমিটার দূর থেকে আমি নিখুঁত নিশানায় ধ্বংস করে দিতে শিখে গেলাম যে কোনো জিনিস। ট্রাকিওশানে অনুপ্রবেশ করানো হল প্রোগ্রাম, উপগ্রহের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হল তার। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে চোখের পলকে যোগাযোগ করা যাবে আমার সাথে। কপালে ফুটো করে সেখানে লাগানো হল ইনফ্রারেড সেল, অন্ধকারে দেখার জন্য চোখের পাতায় সার্জারি করে লাগানো হল মাইক্রোচিপ। আমার রক্তে মেশানো হল বিশেষ হরমোন, নিশ্বাসে দেওয়া হল বিশুদ্ধ অক্সিজেন। আমার চামড়ার নিচে বসানো হল বায়োকেমিক্যাল সেল, শরীরের বিশেষ উত্তেজক ড্রাগ দিয়ে আমার সমস্ত স্নায়ুকে সতর্ক করে রাখা হল সর্বক্ষণের জন্য।
হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রস্তুত করে প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল বিশেষ একটি হলঘরে, সেখানে আমার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল আরো চার জন মানুষ। তাদের দুই জন মধ্যবয়সী, অন্য দুই জন প্রায় তরুণ। তারা স্বল্পভাষী এবং মুখভঙ্গি কঠোর। আমাকে দেখামাত্র তারা শীতল গলায় কথা বলতে শুরু করল। মধ্যবয়স্ক একজন বলল, শত্রুর সাথে যুদ্ধ করার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে শত্রুকে চেনা। আমি খুব দুঃখিত যে এই যুদ্ধে তোমার সেই সৌভাগ্য হবে না।
আমার মুখের মাঝে লাগানো বিচিত্র অস্ত্রটিতে আমি এখনো অভ্যস্ত হতে পারি নি, সেটির কারণে আমার কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছিল, এক ধরনের জড়িয়ে যাওয়া উচ্চারণে বললাম, কেন এ কথা বলছ?
তোমার শত্রুকে চেনা প্রায় দুঃসাধ্য। সে অবলীলায় তার রূপ পরিবর্তন করতে পারে। তার যান্ত্রিক কাঠামোর ওপরে আধা জৈব এক ধরনের টিস্যু রয়েছে, সেটি অবিকল মানুষের ত্বকের মতো। সে ইচ্ছে করলে হুবহু মানুষের রূপ নিতে পারে।
তরুণ মানুষটি কোনো একটি সুইচ স্পর্শ করা মাত্র ঘরের মাঝামাঝি একটি হলোগ্রাফিক ছবি ভেসে এল। আধা যন্ত্র আধা জৈবিক অত্যন্ত কদাকার একটি রূপ। মুখমণ্ডল আকৃতিহীন, চোখের জায়গায় দুটি গভীর গর্ত যার ভিতর থেকে দুটি লাল বর্ণের ফটোসেল জ্বলছে। তরুণটি উত্তাপহীন গলায় বলল, এটি সম্ভবত এই যন্ত্রটির প্রকৃত রূপ। কিন্তু তুমি তাকে এই রূপে দেখবে না। তুমি সম্ভবত তাকে এই রূপে দেখবে–