কী?
কুচকুচে কালো। কয়লার মতো! সূর্যের আলোর শতকরা মাত্র সাত ভাগ চাঁদ ব্যাটা রিফ্লেক্ট করে। সেইটা নিয়েই শালার কত বাহাদুরি।
আজহার ক্রুদ্ধ চোখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে, দেখে মনে হয় পারলে সে বুঝি তখনই চঁদটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। মুখ ভেংচে বলল, দেখেন তাকিয়ে দেখেন। এর মাঝে কোনো সৌন্দর্য আছে? গোল একটা থালার মতো। তাও যদি সুন্দর থালা হত। ফাটাফুটো থালা-দেখেছেন কেমন কালো দাগ? মেছেতার মতো। ছিঃ!
সাজ্জাদ একটু অবাক হয়ে আহজারের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ যে চাঁদ নিয়ে এরকম কিছু বলতে পারে সেটা নিজের কানে না শুনলে সে বিশ্বাস করত না।
আজহার ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চঁদের উল্টা পিঠটা তবু ভালো, খানাখন্দ কালো দাগ কমব্যাটা এমনই খবিস যে তার এই পিঠটাই আমাদের দেখাবে- কখনোই উল্টো পিঠ দেখাবে না।
সাজ্জাদ ভুরু কুঁচকে বলল, তাই নাকি।
হ্যাঁ। আমরা চাঁদের এক পিঠ সব সময়েই দেখি। দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর। উল্টো পিঠ দেখতে হলে সেখানে রকেটে করে যেতে হয়।
সাজ্জাদ মাথা নাড়ল, বলল, ইন্টারেস্টিং।
চাঁদ নিয়ে খালি একটা ভালো খবর আছে। মাত্র একটা।
সেটা কী?
যতই দিন যাচ্ছে এই বদমাইশটা আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে। বছরে এক ইঞ্চির মতন। একসময় এত দূরে চলে যাবে যে তখন আর এই শালা হারামজাদাকে দেখাই যাবে না।
কিন্তু সে তো অনেক পরে। লক্ষ লক্ষ বছর পরে।
সেইটাই আফসোস। তখন বেঁচে থাকব না। যদি বেঁচে থাকতাম তা হলে গরু জবাই করে সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়াতাম। আজহার সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে হা হা করে হাসল, সেই হাসি দেখে সাজ্জাদ কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে থাকে।
.
কয়েক মাস পরের কথা। কক্সবাজারের সমুদ্রতীরে আজহার অন্যমনস্কভাবে হাঁটছে। অনেক রাত-সমুদ্রতীরে কোনো মানুষ নেই, আজহার হঠাৎ করে সেটা বুঝতে পেরে একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে। অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে সে অনেকটা দূর চলে এসেছে-এখনই হোটেলে ফিরে যাওয়া দরকার। ঘুরে হাঁটতে শুরু করতেই সে দেখে দুজন মানুষ ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে তার বুকটা ধক করে উঠল, সে শুকনো গলায় বলল, কে?
একজনের হাতের টর্চ লাইটটা জ্বলে ওঠে, সরাসরি তার মুখে আলো ফেলে মানুষটা জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম আজহার।
হ্যাঁ। কেন? কী হয়েছে?
নূতন কিছু হয় নাই। তবে আগে যেটা হয়েছে সেটা তোমার থেকে ভালো করে কে জানে?
হঠাৎ করে আজহার এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। অনেক কিছুই তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, এবারে সে লোভ একটু বেশি করে ফেলেছে। অপরাধজগতের যে অলিখিত নিয়মের দাগ কাটা থাকে সে তার কোনো একটা দাগ অতিক্রম করে ফেলেছে। কোনো একজন গডফাদারের পা সে না বুঝেই মাড়িয়ে দিয়েছে।
আজহার শুকনো গলায় বলল, ভুল হয়ে গেছে।
ভুল তো হয়েছেই। আবার যেন না হয় সেইটা দেখার একটা দায়িত্ব আছে না?
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা জিজ্ঞেস করল, ওস্তাদ, জানে মেরে ফেলব?
না?
তয়?
হাসপাতালে যেন কমপক্ষে এক মাস থাকতে হয় সেরকম ব্যবস্থা করতে হবে।
ঠিক আছে।
শেষ মুহূর্তে আজহার দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করল কিন্তু বেশি দূর যেতে পারল না, মানুষ দুজন তাকে ধরে ফেলল।
সমুদ্রের বালুকাবেলায় তার কাতর চিৎকার কেউ শুনতে পেল না।
.
আজহার বালু খামচে উঠে বসার চেষ্টা করল, পারল না। আবার সে বালুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। এখান থেকে সে নিজে নড়তে পারবে না। কেউ একজন তাকে নিয়ে না গেলে সে যেতে পারবে না। গভীর রাতে নির্জন বালুকাবেলায় কে তাকে নিতে আসবে? আজহার দাতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করে ভোর হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে।
ঠিক তখন সে আকাশে চাঁদটাকে দেখতে পায়। বড় থালার মতো একটা চাঁদ, আজহারের মনে হল চাঁদটা চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
হারামজাদা। আজহার বিড়বিড় করে বলল, শালা হারামজাদা।
আজহারের হঠাৎ মনে হল চাঁদটা যেন তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে একটু হেসে দিয়েছে। আজহার ভালো করে তাকাল, দুর্বল শরীরে সে এখন উল্টোপাল্টা জিনিস কল্পনা করতে শুরু করেছে?
খুন করে ফেলব। আজহার বিড়বিড় করে বলল, শালা, তোকে খুন করে ফেলব!
আজহার স্পষ্ট দেখতে পেল চাঁদটা আবার ফিক করে হেসে দিয়েছে। শুধু থেমে যায়। নি, ফিসফিস করে বলছে, তোকে আমি খুন করব।
আজহার চমকে উঠে বলল, কী? কী বলছিস তুই?
চাঁদ তার কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে বিদ্রুপের দৃষ্টিতে একদৃষ্টে আজহারের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ঠিক এরকম সময় আজহার হঠাৎ করে ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পায়। সাথে সাথে সে বুঝে যায় চাঁদটা তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে। বালুকাবেলায় সে অসহায়ভাবে শুয়ে আছে সেই সুযোগে চাঁদটা সমুদ্রের পানিকে টেনে আনছে। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তার উপর এনে ফেলবে, লোনা পানিতে ডুবিয়ে মারবে তাকে।
আজহার হিংস্র গলায় বলল, না। না-তুই এটা করতে পারবি না। কিছুতেই করতে পারবি না।
চাঁদ আজহারের হিংস্র চিৎকার আর কাতর অনুনয় কিছুই শুনল না। সমুদ্রের পানি টেনে এনে আজহারকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
অনন্তকাল থেকে দিনে দুইবার সে পানিকে এভাবে টেনে আনছে। পৃথিবীর মানুষ এটার নাম দিয়েছে জোয়ার।
.
আজহার অবিশ্যি সেটা কখনোই বিশ্বাস করে নি।
জিনোম জনম
০১.