সাজ্জাদ চমকে উঠে বলল, কী বললেন?
বলেছি শালা হারামজাদা।
কাকে বললেন?
চাঁদটাকে।
আজহার আর সাজ্জাদ অফিসের কাজে এই এলাকায় এসে ছিমছাম একটা গেস্ট হাউজে উঠেছে। রাতে খাবার পর দুজনে হাঁটতে বের হয়েছে, গাছপালা ঢাকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে একটা ফাঁকা জায়গায় হাজির হতেই হঠাৎ করে থালার মতো বিশাল পূর্ণিমার চাঁদটা তাদের চোখে পড়েছে। শহরের ব্যস্ত কাজকর্মের মাঝে কেউ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে না, এই নিরিবিলি এলাকায় না চাইলেও আকাশের দিকে তাকাতে হয়, চাঁদটা দেখতে হয়।
সাজ্জাদ জোছনার আলোতে আজহারের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে বলল, আপনি চাঁদটাকে শালা হারামজাদা বলে গালি দিচ্ছেন?
আজহার মুখ শক্ত করে বলল,হ্যাঁ দিচ্ছি।
কেন?
ওই শালা হারামজাদার জন্যে আমি আমার লাইফের সবচেয়ে বড় দাওটা মারতে পারি নি। যদি মারতে পারতাম তা হলে এখন আমি ব্যাংকক সিঙ্গাপুরে ফাইভস্টার হোটেলে বিজনেস করতাম। আপনার সাথে এই পাড়গ্রামের রেস্ট হাউজে কই মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে অন্ধকারে মশার কামড় খেতে খেতে কাদামাটিতে হাঁটতাম না।
আজহারের কথার ভঙ্গি যথেষ্ট উদ্ধত, সাজ্জাদ সূক্ষ্মভাবে অপমানিত বোধ করল। সেটা অবিশ্যি সে বুঝতে দিল না, বলল, কী হয়েছিল?
লম্বা স্টোরি।
বলেন শুনি।
আজহার একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তখন নূতন বিজনেস শুরু করেছি। একটা মালদার ইন্টারন্যাশনাল এনজিওকে ধরে খুব বড় একটা প্রজেক্ট বাগিয়েছি। হাওর এলাকায় উন্নয়ন যে গ্রামগুলো আছে তার ইলেকট্রিফিকেশান, হাওরের পানিতে লাইফ সাপোর্ট, এরকম অনেক কিছু। কোনোরকম দুই নম্বুরি না করলেও নিট প্রফিট দুই কোটি টাকা। বিদেশী এনজিও একটু গাধা টাইপের হয়। একটু ভুচুং ভাচুং করে মাথায় হাত বুলালে আরো এক দেড় কোটি টাকা।
আজহার কথা বন্ধ করে দেয়াশলাইয়ের কাঠি বের করে দাঁত খোঁচাতে থাকে। সাজ্জাদ জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হল?
সব যখন ঠিকঠাক তখন কান্ট্রি ডিরেক্টর বলল জায়গাটা একবার নিজের চোখে দেখতে চায়। আমেরিকান বুড়া, মাথায় একটু ছিট আছে। আমি আর কী করি, একটা ট্রলার ভাড়া করে তাকে হাওরে নিয়ে গেছি। বর্ষাকাল হাওর পানিতে টইটম্বুর। দিনের বেলা সবকিছু দেখে ফিরে আসতে আসতে সন্ধে হয়ে গেছে। ঠিক তখন বিশাল হাওরের মাঝখানে হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন একটা চাঁদ উঠল। বিশাল একটা চাঁদ, দেখে টাসকি লেগে যাবার অবস্থা। সেই চাঁদ দেখে আমেরিকান বুড়ার মাথা পুরাপুরি আউলে গেল। সে চাঁদের দিকে তাকায় আর বুকের মাঝে থাবা দিয়ে বলল, ও মাই গড। ও মাই গড। হাউ বিউটিফুল! তারপর আমার দিকে তাকিয়ে কী বলল জানেন?
বলল, এত সুন্দর জায়গা ইলেকট্রিফিকেশান করা যাবে না, প্রকৃতিকে ডিস্টার্ব করা যাবে না। এটাকে এইভাবেই রাখতে হবে। কোনোভাবে হাওরের পানিতে এই সুন্দর চাঁদের দৃশ্য নষ্ট করা যাবে না। এক কথায় পুরা প্রজেক্ট ক্যান্সেল।
ক্যান্সেল?
আজহার দাঁত ঘষে বলল, হ্যাঁ, ক্যান্সেল। ইচ্ছা হচ্ছিল শালা বুড়া ভামকে ধাক্কা মেরে হাওরের পানিতে ফেলে দিই। সাথে অন্য লোকজন ছিল তাই শেষ পর্যন্ত ফেলি নাই। তবে
তবে কী?
বুড়া ভামকে আমি ছাড়ি নাই।
ছাড়েন নাই?
না। পরিচিত মাস্তান আছে তারে দিয়ে এমন ধোলাই দিয়েছি যে ব্যাটা জন্মের মতো সিধা হয়ে গেছে।
সাজ্জাদ একটু ইতস্তত করে বলল, ধোলাই? মানে মারপিট?
নয়তো কী? সকালে লেকের পাড়ে মর্নিং ওয়াকে বের হয় সেইখানে একলা পেয়ে আচ্ছা মতন পালিশ দেয়া হল। এক মাস হাসপাতালে তারপর সোজা দেশে ফেরত। আজহার হা হা করে হাসল, আনন্দহীন হাসি।
সাজ্জাদ একটু নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনি তো ডেঞ্জারাস মানুষ।
আজহার পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, সেইটা ভুল বলেন নাই। আমি মানুষটা একটু ডেঞ্জারাস! জীবনে অকাম কুকাম কম করি নাই।
আজহার হঠাৎ সুর পাল্টে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তা যাই হোক আপনাকে এই সব কথা বলেছি সেটা যেন দশজনকে বলে বেড়াবেন না। কথায় কথায় হঠাৎ মুখ ফসকে বের হয়ে গেল।
সাজ্জাদ ভয়ে ভয়ে বলল, না বলব না।
হ্যাঁ বলবেন না। বললে বিপদ। আমার আপনার দুই জনেরই।
কেন দুজনেরই বিপদ সেটা সাজ্জাদ ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু সেটা নিয়ে কথা বলার সাহস করল না। একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, আপনার ক্ষতি করেছে চাঁদটা। আপনার তো শোধ নেয়ার দরকার ছিল চাঁদের উপর। খামকা বুড়ো কান্ট্রি ডিরেক্টর-
নিচ্ছি চাঁদের উপর নিচ্ছি।
কীভাবে নিচ্ছেন?
এই যে উঠতে বসতে ব্যাটাকে শালা হারামজাদা বলে গালি দেই। কত বড় খচ্চর সেটা সবাইকে বলি।
খচ্চর? চাঁদ খচ্চর?
খচ্চর নয়তো কী? ব্যাটার নিজের কোনো আলো নেই, সূর্যের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে কত বড় দালালি!
কিন্তু কী সুন্দর চাঁদের আলো। কী নরম জোছনা–
কাঁচকলা। আজহার মুখ বিকৃত করে বলল, দুনিয়াতে কত সুন্দর রঙ আছে লাল নীল সবুজ হলুদ, এই ভুয়া চাঁদের আলোতে কি কোনো রঙ দেখা যায়? যায় না।
সাজ্জাদ দুর্বলভাবে বলার চেষ্টা করল, কিন্তু সেটায় তো একটা অন্য রকম সৌন্দর্য আছে।
ভুয়া। ভুয়া সৌন্দর্য। চাঁদের আলোটাই ভুয়া।
কিন্তু আমি তো কাউকে কখনো বলতে শুনি নি চাঁদের আলো ভুয়া।
কেউ জানে না সেই জন্যে বলে না। সেইটাই হচ্ছে সমস্যা। আপনি জানেন চাঁদের আসল রঙ কী? জানেন?