মহিলাটি ডায়ালটা সাবধানে একটু ঘুরিয়ে সুইচটা টিপে ধরল, সাথে সাথে চেয়ারে বেঁধে রাখা মানুষটা একটু কেঁপে উঠে এদিক-সেদিক তাকাল। ছোট একটা ইলেকট্রিক শক খেয়েছে মনে হয়। মহিলাটি ডায়ালটা আরেকটু ঘুরিয়ে আবার সুইচটা টিপে ধরতেই মানুষটা কেঁপে উঠে একটা ছোট শব্দ করল। হঠাৎ করে এই মানুষটার চেহারায় একটা ভয়ের ছাপ পড়ে। সে এদিকে সেদিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করতে শুরু করেছে।
মহিলাটি ডায়ালটা আরেকটু ঘুরিয়ে আবার সুইচ টিপে ধরতেই মানুষটা প্রথমবার একটু চিৎকার করে উঠল। তার মুখে এই প্রথমবার শুধু ভয় নয় আতঙ্কের ছাপ পড়েছে। মহিলাটি আবার ডায়াল একটুখানি ঘুরিয়ে সুইচটা টিপে ধরতেই মানুষটা হঠাৎ বিচিত্র ভঙ্গিতে কেঁপে ওঠে, তার মুখটা বিকৃত হয়ে যায়, এবং তার ভেতরে সে গোঙানোর মতন শব্দ করে ওঠে। মহিলাটা জিব দিয়ে তার ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়, মনে হচ্ছে এখন সত্যিকার অর্থে ইলেকট্রিক শক দেয়া শুরু হয়েছে-সে ডায়ালটার দিকে তাকাল এখনো অনেক দূর যাওয়া বাকি। মাত্র শুরু হয়েছে-যখন আরো বেশি শক দেয়া হবে মানুষটা কী করবে কে জানে।
মহিলাটি ডায়ালটা বেশ খানিকটা ঘুরিয়ে সুইচটা টিপে ধরতেই মানুষটা চেয়ার থেকে লাফিয়ে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে, থরথর করে সারা শরীর কাঁপতে থাকে সাথে সাথে সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে-যন্ত্রণার অমানুষিক একটা চিৎকার। সুইচটা যতক্ষণ টিপে রাখার কথা মহিলাটি তার থেকে কয়েক মুহূর্ত বেশি সময় টিপে ধরে রাখল। মানুষটাকে যন্ত্রণা দেয়ার মাঝে অত্যন্ত বিচিত্র একটা আনন্দ রয়েছে যেটা সে আগে কখনোই অনুভব করে নি। চেয়ারে বেঁধে রাখা মানুষটা এবারে সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছে, তার সারা মুখ ফ্যাকাসে এবং রক্তশূন্য, মুখ হাঁ করে রেখেছে এবং চোখগুলোতে অবর্ণনীয় আতঙ্ক।
মহিলাটি জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে ডায়ালটা আরো বেশ খানিকটা ঘুরিয়ে কাঁপা হাতে সুইচটা টিপে ধরে সাথে সাথে চেয়ারে বেঁধে রাখা মানুষটা অমানুষিক যন্ত্রণায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে। তার সারা শরীর এক ধরনের ভয়াবহ খিচুনিতে থরথর করে কাঁপছে। মনে হয় চোখ দুটো কোটর থেকে ঠেলে বের হয়ে আসছে। মানুষটা মুখ হাঁ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করছে কিন্তু মনে হচ্ছে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।
যন্ত্রণাকাতর মানুষটিকে দেখে মহিলাটির মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে আসে। সে সুইচটা টিপে ধরে রেখে অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় কেঁপে কেঁপে ওঠা মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে, নিজের অজান্তেই সে একটু পরে পরে মুখে লোল টেনে নিতে থাকে।
.
মনিটরে মহিলাটির কঠিন মুখটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রফেসর নিচু গলায় তার সহকর্মীকে বললেন, কেমন দেখছ?
অবিশ্বাস্য। একজন মানুষ যে অকারণে আরেকজন মানুষকে এভাবে কষ্ট দিতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। সহকর্মী মাথা নেড়ে বলল, আমার রীতিমতো শরীর খারাপ লাগছে।
প্রফেসর সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন তোমার শরীর খারাপ লাগছে? তুমি তো জানো এখানে কোনো ইলেকট্রিক শক দেয়া হচ্ছে না–পুরোটাই মানুষটার অভিনয়।
জানি। আমি খুব ভালো করে জানি। সবকিছু তো আমিই তৈরি করেছি-যন্ত্রপাতি পুরোটাই বোগাস আমি সেটা জানি। কিন্তু মানুষটার অভিনয় এত রিয়েলিস্টিক মনে হচ্ছে আসলেই বুঝি ইলেকট্রিক শক খাচ্ছে!
প্রফেসর দুলে দুলে হাসতে হাসতে বললেন, উনিশ শ একষট্টি সালে স্ট্যানলি মিলগ্রাম প্রথম এই এক্সপেরিমেন্টটা করেছিলেন। সারা পৃথিবীতে তখন হইচই পড়ে গিয়েছিল।
পড়ারই কথা। নির্বোধ মহিলাটা ভাবছে সে এক্সপেরিমেন্ট করছে! আসলে তাকে নিয়েই যে এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে সে জানতেও পারছে না।
প্রফেসর বললেন, সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে মজার ব্যাপার।
সহকর্মী নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু কী লাভ এই রকম এক্সপেরিমেন্ট করে? আমরা তো এক্সপেরিমেন্ট ছাড়াই জানি মানুষ কত নিষ্ঠুর হতে পারে!
প্রফেসর মাথা নেড়ে বললেন, জানি না। ভাসা ভাসা জানি ঠিক করে জানি না। এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে এতগুলো টাকা পেয়েছি কেন এক্সপেরিমেন্ট করব না?
সহকর্মী সোজা হয়ে বসে বলল, হ্যাঁ, অনেকগুলো টাকা দিয়েছে এই প্রজেক্টে, সেরকম খরচ তো নেই!
খরচ নেই তো কী হয়েছে? খরচ করে ফেলব! আমাদের এই অভিনেতাকে টাকা দিয়ে খুশি করে দেব। এরকম প্রফেশনাল অভিনেতা না হলে এই এক্সপেরিমেন্টটা এত ভালো করে করতে পারতাম? কিছু যন্ত্রপাতি কিনব। দেশে বিদেশে কনফারেন্সে যাব-টাকা খরচ করা কোনো সমস্যা নাকি?
সহকর্মী প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু একটা প্রাইভেট কোম্পানি আপনাকে গবেষণা করার জন্যে এত টাকা কেন দিল?
প্রফেসর মাথা নেড়ে বললেন, জানি না। মনে হয় গাধা টাইপের কোম্পানি! ম্যানেজিং ডিরেক্টর মানুষটাও মনে হয় গাধা টাইপের–
কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ঠিক সেই মুহূর্তে প্রফেসরের ঘরে গোপনে বসিয়ে রাখা ক্যামেরাতে প্রফেসরকে লক্ষ করছিলেন। পাশে বসে থাকা সেক্রেটারি বলল, স্যার, শুনলেন? বলছে আমাদের কোম্পানিটা নাকি গাধা টাইপের আর আপনিও নাকি গাধা টাইপের মানুষ।
শুনেছি।
চার পয়সার প্রফেসরের কত বড় সাহস! যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা।