ক্যাপ্টেন রন হাত নেড়ে খ্রাউসকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে। তুমি লানাকে বল তথ্যকেন্দ্র থেকে যেন পদার্থবিজ্ঞানের তথ্য বিনিময় করা হয়।
লানা হতাশার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমি যখন এই মহাকাশযানে যোগ দিয়েছিলাম তখন ভেবেছিলাম আর বুঝি পদার্থবিজ্ঞান আমাকে উৎপাত করবে না। স্কুলে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পদার্থবিজ্ঞান বিষয়টা আমাকে কী কষ্ট দিয়েছে জানো?
খ্রাউস অপরাধীর মতো বলল, আসলে বিষয়টা এত খারাপ না। স্কুল-কলেজে ঠিক করে পড়ায় না তো সেজন্যে কেউ পছন্দ করে না। যাই হোক আমি যেটা বলছিলাম–
খ্রাউস কী বলছিল সেটা কেউ শুনতে চাইল না। সবারই অনেক কাজ, কারো এখন পদার্থবিজ্ঞানের হেঁয়ালি শোনার সময় নেই।
.
পরবর্তী ছয় দিনও কেউ ব্রাউসের কথা শোনার সময় পেল না। মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত, তাদের জন্যে তথ্য বিনিময় করাও খুব সহজ ছিল না। তারপরেও তার চেষ্টা করা হল। মহাজাগতিক প্রাণীটি সিলিকনভিত্তিক, বুদ্ধিমত্তা মানুষের মতো মস্তিষ্কে কেন্দ্রীভূত নয়, সেটা পরিব্যাপ্ত। মহাকাশযানের ইঞ্জিনে সমস্যা হয়েছে-এক ধরনের জ্বালানি সংকট রয়েছে। খ্রাউসের একান্ত ইচ্ছার কারণে পদার্থবিজ্ঞানেরও কিছু তথ্য বিনিময় করা হয়েছে। বিজ্ঞানে তারা মানুষ থেকে খানিকটা পিছিয়ে আছে দশ মাত্রার স্ট্রিং থিওরির সমাধান করেছে কিন্তু চৌদ্দ মাত্রার অবতল থিওরি এখনো সমাধান করতে পারে নি।
সপ্তম দিনে যখন মহাকাশযান টাইটুনের ক্রুরা প্রথমবার সরাসরি মহাকাশযানটিকে দেখতে পেল তখন তাদের উত্তেজনার কোনো সীমা ছিল না। আকৃতিটা অত্যন্ত বিচিত্র, পৃথিবীর কোনো কিছুর সাথে তার কোনো মিল নেই। পৃথিবীর প্রযুক্তিতে কোনো কিছু তৈরি করতে হলে তার মাঝে জ্যামিতিক কিছু আকার থাকে–এই মহাকাশযানে সেরকম কিছু। নেই, মনে হয় পুরোটাই বুঝি একটু একটু করে নিজে থেকে গড়ে উঠেছে। মহাকাশযানটির ইঞ্জিন বিধ্বস্ত তাই সেটি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, নির্দিষ্ট একটা গতিতে অসহায়ভাবে এগিয়ে আসছে।
ক্যাপ্টেন রন মহাকাশযান টাইটুনকে মহাজাগতিক প্রাণীদের মহাকাশযানটির গতিপথের সাথে একই সরলরেখায় উপস্থিত করে। তারপর খুব ধীরে ধীরে তার গতিপথ কমিয়ে আনতে থাকে-যখন দুটো মহাকাশযান একটি অন্যটিকে স্পর্শ করবে তখন একটি মহাকাশযানের তুলনায় অন্যটির গতিবেগ হবে শূন্য। মহাকাশে ভিন্ন ভিন্ন মহাকাশযানের একত্রিত হওয়ার এটি একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি।
কন্ট্রোল প্যানেলে সবাই এসে ভিড় করেছে, সবার ভেতরেই এক ধরনের উত্তেজনা। খুব ধীরে ধীরে মহাকাশযান দুটো একটি আরেকটির দিকে এগিয়ে আসছে আর কিছুক্ষণের ভেতরেই মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে। এরকম সময়ে কন্ট্রোল প্যানেলে একটা সংকেত ধরা পড়ল, ক্যাপ্টেন রন জিজ্ঞেস করল, কী পাঠিয়েছে?
রাটুল বলল, সামনের মহাকাশযান থেকে একটা বার্তা।
কী বলেছে বার্তায়?
রাটুল পড়ে শোনাল, তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তোমাদের প্রতি ভালবাসা। তোমাদের প্রতি শুভেচ্ছা। তোমাদের প্রতি কাজামিনু।
কাজামিনু? কাজামিনু অর্থ কী?
সুপার কম্পিউটার এটা অনুবাদ করতে পারে নি। মানুষের ভাষায় এটা নেই। নিশ্চয়ই। কৃতজ্ঞতা, ভালবাসা বা শুভেচ্ছার মতো একটা শুভ কামনা।
ক্যাপ্টেন রন বলল, ঠিক আছে। আমরাও তাদের জন্যে একটা বার্তা পাঠাই। তাদেরকে বল, পৃথিবীর মানবজাতির পক্ষ থেকে শুভ কামনা। এই মিলনমেলায়–
খ্রাউস হঠাৎ বাধা দিয়ে বলল, না।
ক্যাপ্টেন রন অবাক হয়ে বলল, না? না কেন?
খ্রাউস অস্থির গলায় বলল, ভালবাসা শুভ কামনার অনেক সময় আছে। একটু পরেও সেটা পাঠানো যাবে। এখন যেটা দরকার সেটা পাঠাও।
এখন কী দরকার?
তাদের কাছে একটা বার্তা পাঠিয়ে বল তারা যেন তাদের ডান দিকের লাইটটা জ্বালায়।
ডানদিক?
হ্যাঁ।
কেন ডানদিক?
তোমাকে সেটা পরে বলছি-আমাদের হাতে এখন সময় নেই। আমরা একে অপরকে স্পর্শ করার আগেই একটা জিনিস জানা দরকার। ডান বলতে তারা কী বোঝায় সেটা জানা দরকার।
ক্যাপ্টেন রন একটু অধৈর্য হয়ে বলল, কিন্তু আমরা ডান বলতে কী বোঝাই সেটা কি তারা জানে?
জানে। আমরা পদার্থবিজ্ঞানের তথ্য বিনিময় করেছি। প্যারিটি ভায়োলেশন থেকে সেটা জানা সম্ভব। তারা জানে-আমি সেটা নিশ্চিত করেছি।
কমিউনিকেশন অফিসার রাটুল ক্যাপ্টেন রনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী করব ক্যাপ্টেন?
ঠিক আছে আগে ব্রাউসের বার্তাটা পাঠাও। বল, তারা যেন তাদের ডান দিকের বাতিটি জ্বালায়।
রাটুল ক্ষীপ্র হাতে একটা কি-বোর্ডে কথাগুলো লিখে সুপার কম্পিউটারে পাঠাল। সুপার কম্পিউটার সেই তথ্যটি মহাজাগতিক প্রাণীদের উপযোগী করে সাজিয়ে নিয়ে মূল এন্টেনা দিয়ে পাঠিয়ে দেয়।
কিছুক্ষণের মাঝেই বার্তাটি মহাজাগতিক প্রাণীদের মহাকাশযান গ্রহণ করে। খ্রাউস অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে এবং অন্যেরা খানিকটা কৌতুকভরে এগিয়ে আসা মহাকাশযানটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মহাকাশযানটির ডান বা বাম কোনো দিকেই বাতি জ্বলল না, তার বদলে কন্ট্রোল প্যানেলে নূতন একটি বার্তা এসে হাজির হল। সেখানে লেখা, তোমরা কেন ডান দিকে বাতি জ্বালাতে বলছ? আমাদের জ্বালানি সংকট। বাতি জ্বালিয়ে জ্বালানি অপচয় করতে চাই না।