ঠিক এরকম সময় বাস ড্রাইভার ব্রেক কষে বাসটা থামিয়ে একটা বিস্ময়ের শব্দ করল। নীল জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে!
আশ্চর্য ব্যাপার! বিশাল দেহের ড্রাইভার হাত নেড়ে বলল, আমি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে রওনা দিয়েছিলাম-চলে এসেছি রেলস্টেশনে!
নীল এবং তার সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল। ড্রাইভার অবাক হয়ে বলল, কী হল? তোমরা সবাই উঠেছ কেন? বস। যার যার সিটে বস।
নীল ইলেকট্রনিক সুইচটা টিপে ধরতেই শব্দ করে বাসের দুটি দরজা খুলে গেল। সবাই হুড়মুড় করে নামতে থাকে, বাস ড্রাইভার চোখ কপালে তুলে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করতে থাকে-–সিট বেল্টে বাধা বাস ড্রাইভার তার বেন্ট খুলে উঠতে উঠতে যেটুকু সময় লাগে তার মাঝে সবাই বাস থেকে নেমে ছুটতে শুরু করেছে। বাস ড্রাইভার আতঙ্কিত মুখে বলল, কোথায় যাও তোমরা? কোথায় যাও?
শেষ ছেলেটি গলা উঁচিয়ে বলল, শপিং সেন্টার। তারপর মুহূর্তের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বাস ড্রাইভার কী করবে বুঝতে না পেরে বাসের সিঁড়িতে বসে পড়ে। পকেট থেকে ভিডিফোন বের করে সে কাঁপা হাতে ডায়াল করতে থাকে। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের বাচ্চাগুলো এই বাস থেকে নেমে গেছে, আজকে তার সর্বনাশ হয়ে যাবে। শুধু তার না, আরো অনেকের সর্বনাশ হবে!
১৪.
গুস্তাভ তার পিকআপ ট্রাকের পিছনের টায়ারে একটা লাথি দিয়ে সেটাকে পরীক্ষা করে মুখ দিয়ে সন্তুষ্টির একটা শব্দ করে রিকির দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যি সত্যি তোমার বন্ধুরা আসবে তো?
রিকি হাতে কিল দিয়ে বলল, একশবার আসবে।
এত ছোট ছোট বাচ্চা কেমন করে আসবে? কোনো ঝামেলায় না পড়ে যায়!
রিকি দাঁত বের করে হাসল, বলল, ছোট বাচ্চা হলে কী হবে? তাদের মাথার বুদ্ধি বড় মানুষ থেকে অনেক বেশি।
গুস্তাভ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সেইটাই হচ্ছে বিপদ। ছোট মানুষের বুদ্ধি যদি বড় মানুষ থেকে বেশি হয় তা হলে সেইটা খুব বড় বিপদ।
কেন বড় বিপদ কেন?
বড় মানুষেরা ভুল করে আর সেই জন্যে ছোট মানুষদের একশ রকম ঝামেলা হয়।
ঠিক এই সময় একটা ট্রেনের চাপা গর্জন শোনা গেল, মাটিতে একটা মৃদু কম্পন শোনা যায় এবং একসময় শব্দটা মিলিয়ে আসে।
গুস্তাভ পিচিক করে রাস্তার পাশে থুতু ফেলে বলল, নয়টা বাহান্নর ট্রেন এসেছে। দেখা যাক তোমার বন্ধুরা আসতে পেরেছে নাকি!
কিছুক্ষণ পরেই প্যাসেঞ্জাররা বের হয়ে আসতে থাকে এবং তাদের মাঝে ছোট একটা বাচ্চাকে গুটিগুটি এগিয়ে আসতে দেখা গেল। বাচ্চাটির চোখে-মুখে উদ্বেগের একটা চিহ্ন স্পষ্ট, রাস্তার পাশে রিকিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুহূর্তে তার সমস্ত উদ্বেগ দূর হয়ে গেল। বাচ্চাটি ছুটে রিকির কাছে এসে বলল, তুমি এসেছ? আমরা যা দুশ্চিন্তায় ছিলাম!
রিকি বলল, কোনো দুশ্চিন্তা নাই। পিকআপ ট্রাকের পিছনে উঠে শুয়ে পড় যেন বাইরে থেকে দেখা না যায়!
বাচ্চাটি পিকআপ ট্রাকের পিছনে উঠতে উঠতেই একজন দুইজন করে অন্য বাচ্চারাও উদ্বিগ্ন মুখে বের হতে শুরু করল। রিকি তাদের সবাইকে পিকআপ ট্রাকের পিছনে তুলতে থাকে। সবার শেষে এল নীল, সে ছুটে এসে রিকির হাত ধরে বলল, সবকিছু ঠিক আছে?
রিকি বুড়ো আঙুল উপরে তুলে বলল, শতকরা একশ দশ ভাগ!
চমৎকার। চল তা হলে যাই।
পিকআপ ট্রাকের মেঝেতে সবাই গাদাগাদি করে শুয়ে আছে, গুস্তাভ সবাইকে একনজর দেখে গোঁফে একবার হাত বুলিয়ে বলল, এই ট্রাকে করে আমি শহরে হাঁস-মুরগি নিয়েছি, শাক-সবজি নিয়েছি, বালু-পাথর নিয়েছি কিন্তু এরকম কার্গো কখনো নিই নি!
রিকি বলল, ভালোই তো হল এখন তোমার লিস্টিটা আরো বড় হল!
তা হয়েছে কিন্তু ধরা না পড়ে যাই।
ধরা পড়বে না গুস্তাভ। আমরা সবাই মাথা নিচু করে শুয়ে থাকব কেউ দেখবে না।
গুস্তাভ পিকআপের পিছনের ডালাটা বন্ধ করতে করতে বলল, শহরতলিটা পার হলেই সোজা হয়ে বসতে পারবে। জঙ্গলের রাস্তায় আজকাল কোনো মানুষজন যায় না।
পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় পিকআপ, ঝাঁকুনিতে সবার শরীর থেকে হাড় এবং মাংস আলাদা হয়ে যাবার অবস্থা কিন্তু কেউ সেটা নিয়ে কোনো অভিযোগ করল না। বরং তারা হাসিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল, দেখে মনে হতে লাগল খানাখন্দে ভরা রাস্তায় লক্কড়ঝক্কড় একটা পিকআপে করে ঝাঁকুনি খেয়ে খেয়ে তার মেঝেতে শুয়ে থেকে যাবার মতো আনন্দ বুঝি আর কিছুতে নেই।
কিছুক্ষণের মাঝেই ড্রাইভিং সিট থেকে গুস্তাভ চিৎকার করে বলল, এখন তোমরা উঠে বসতে পার। জঙ্গলের রাস্তায় চলে এসেছি।
সাথে সাথে সবাই উঠে বসে, বাতাসে তাদের চুল উড়তে থাকে, তারা সবিস্ময়ে বাইরে তাকায়। দুই পাশে ঘন অরণ্য একসময় সেখানে মানুষের বসতি ছিল হঠাৎ করে ঝোঁপঝাড় লতাগুলো ঢাকা একটি দুটি ধসে যাওয়া বাড়িঘর সেটি মনে করিয়ে দিচ্ছে।
ধীরে ধীরে রাস্তা খারাপ থের্কে আরো খারাপ হতে থাকে। বড় একটা ঝাঁকুনি খেয়ে পিকআপের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবার পর গুস্তাভ রাস্তার পাশে পিকআপটা থামিয়ে বলল, আমার গাড়ি আর যাবে না! তোমাদের এখানেই নামতে হবে গো।
সবাই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, পিকআপের ডালাটা খোলা মাত্রই তারা লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে শুরু করে। একজন আরেক জনকে ধাক্কা দিতে দিতে তারা সবিস্ময়ে এদিক-সেদিক তাকাতে থাকে। নীল পুরো পিকআপটা একপাক ঘুরে দেখে নিয়ে গুস্তাভকে জিজ্ঞেস করল, তোমার এই গাড়িটা কোন বছরের?