কোনো দরকার নাই মনে রাখার। আমরা যদি একসাথে খেলি তা হলেই নাম মনে হয়ে যাবে। তাই না?
সবাই মাথা নাড়ল।
লাল চুলের মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, কী খেলবে নীল।
রকেট মেশিন খেলতে পারি। নীল রিকিকে জিজ্ঞেস করল, তুমি রকেট মেশিন খেলা জানো?
না।
তা হলে কোনটা জান?
আমি কোনো খেলা জানি না।
তুমি কোনো খেলা জান না?
না।
তা হলে তুমি কী কর?
আমি জঙ্গলে বেড়াই। না হলে হ্রদে ভেলা নিয়ে ভাসি। মাঝে মাঝে আকাশে উড়ি।
কী কর? মাতিষা নামের মেয়েটা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী কর তুমি?
আকাশে উড়ি।
তুমি কি পাখি যে আকাশে উড়ো?
রিকি হেসে বলল, ধুর বোকা! আমি কি বলেছি আমি পাখির মতো পাখা দিয়ে উড়ি? আমি গ্লাইডার দিয়ে উড়ি!
নীল মাথা নেড়ে বলল, গ্লাইডার! কী দারুণ!
হ্যাঁ। আমার বাবা বানিয়েছে। ভেতরে ঝুলে পাহাড়ের ওপর থেকে ছুটে লাফ দিতে হয় তখন সেটা আকাশে ভেসে ভেসে নিচে নামে। দুপুরবেলা যদি গরম বাতাস ওপরে উঠতে থাকে তখন অনেকক্ষণ আসা যায়।
কিয়া নামের মেয়েটা বলল, তোমার ভয় করে না।
রিকি হিহি করে হেসে বলল, ধুর! বোকা মেয়ে! ভয় করবে কেন? গ্লাইডার কখনো পড়ে যায় না। কিন্তু আমার মা ভয় পায়।
কিয়া গম্ভীর মুখে বলল, তয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
রিকি মাথা নাড়ল, বলল, আমার মা অনেক কিছু ভয় পায়। মাকড়সাকে ভয় পায়। টিকটিকিকে ভয় পায়। সাপকে ভয় পায়।
মাতিষা জিজ্ঞেস করল, তুমি কি সাপকে ভয় পাও না?
কেন ভয় পাব?
যদি কামড় দেয়।
কেন কামড় দেবে শুধু শুধু? সাপকে বিরক্ত না করলে সে মোটেও কামড়াবে না। তা ছাড়া এখানে যে সাপ থাকে তাদের বিষ নেই।
তুমি কেমন করে জান?
জানি। আমি তো জঙ্গলে ঘুরি–সেই জন্যে এগুলো জানতে হয়।
নীল তীক্ষ্ণ চোখে রিকির দিকে তাকিয়েছিল এবারে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমরা যদি তোমার সাথে জঙ্গলে যেতে চাই, গ্লাইডারে উড়তে চাই তুমি আমাদের নেবে?
কেন নেব না।
মাতিষা মাথা নাড়ল, বলল, বড়রা আমার কোনোদিন যেতে দেবে না। বলবে। সিমুলেশনে নাই।
কিয়া বলল, আমার আর সিমুলেশন মতো চলতে ইচ্ছা করে না।
আমারও করে না।
নীল বলল, চল আমরা সবাই রিকির সাথে পালিয়ে যাই।
সবাই চোখ বড় বড় করে নীলের দিকে তাকাল, পালিয়ে যাবে?
হ্যাঁ। আমার খুবই গ্লাইডারে উড়ার ইচ্ছে করছে।
কিয়া বলল, আমার বানরের বাচ্চা দেখার ইচ্ছে করছে। সেটা খামচি দেবে না তো?
রিকি বলল, আমার সাথে থাকলে দেবে না।
মাতিষা বলল, আমার ভেলায় উঠতে ইচ্ছে করছে। ভেলা ডুবে যাবে না তো?
রিকি দাঁত বের করে হাসল, বলল, ভেলা কখনো ডুবে না। নৌকা ডুবে যায় কিন্তু ভেলা ডুবে না।
মাতিষা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি শুধু টেলিভিশনে হ্রদের ছবি দেখেছি। সত্যিকারের হ্রদ দেখি নাই। হ্রদ দেখতে কি খুবই সুন্দর?
রিকি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। খুবই সুন্দর। হ্রদের নিচে একটা শহর ডুবে আছে। সেটা দেখলে তোমাদের মাথা খারাপ হয়ে যাবে। তোমরা সাঁতার জানো তো?
জানি। কিন্তু আমি শুধু সুইমিংপুলে সাঁতার কেটেছি। পানিতে ক্লোরিনের গন্ধ। ইয়াক থুঃ!
হ্রদের পানিতে কোনো গন্ধ নাই।
মাতিষা মুখ শক্ত করে বলল, আমিও পালাতে চাই।
নীল বলল, কারা কারা পালাতে চাও হাত তুল।
রিকি অবাক হয়ে দেখল সবাই হাত তুলেছে। নীল গম্ভীর হয়ে বলল, চমৎকার! তা হলে একটা পরিকল্পনা করতে হবে। বড়রা কোনোদিনও আমাদের পালাতে দিবে না।
লন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। তারা সিমুলেশনের বাইরে কিছুই করতে চায় না।
শান্তশিষ্ট চেহারার একজন বলল, যদি বড়রা আমাদের ওপর রাগ হয়?
তা হলে আমরাও বড়দের ওপর রাগ হব। বলব, আমরা সিমুলেশন মানি না। তখন সবাই ভয় পেয়ে যাবে। তারা সিমুলেশনকে খুব ভয় পায়।
মাতিষা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বড়রা খুবই বোকা।
সবাই মাথা নাড়ল, একজন বলল, হ্যাঁ, তাদের বোকামির তুলনা নেই।
নীল ভুরু কুঁচকে বলল, রবিবার।
রবিবার কী?
আমরা রবিবার পালাব। মনে আছে রবিবার আমাদের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট দেখতে যাওয়ার কথা?
হ্যাঁ। মনে আছে।
আমরা সেখানে না গিয়ে রিকির বাসায় চলে যাব।
কীভাবে?
নীল দাঁত বের করে হাসল, বলল, চিন্তা করে একটা বুদ্ধি বের করব।
অন্যেরা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ চিন্তা করে বুদ্ধি বের করব।
চল, এখন তা হলে আমরা খেলি।
এস, আমরা রিকিকে রকেট মেশিন খেলাটা শিখিয়ে দেই।
হ্যাঁ। রকেট মেশিন খুবই মজার একটা খেলা।
কিয়া মনে করিয়ে দিল, আমাদের যে রিকির বুদ্ধিমত্তার ওপর একটা রিপোর্ট লিখতে হবে?
সেটা আমরা বানিয়ে বানিয়ে লিখে ফেলব।
কিয়া দাঁত বের করে হেসে বলল, তারা বুঝতেও পারবে না যে আমরা বানিয়ে বানিয়ে লিখেছি!
এরপর সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে রকেট মেশিন খেলতে শুরু করল, যা একটা মজা হল সেটা বলার মতো নয়।
১২.
হাসি-খুশি শিক্ষিকার কাছে বাচ্চাগুলো যে রিপোর্টটি দিল সেটা ছিল এরকম :
রিকি নামের ছেলেটির বুদ্ধিমত্তা খুবই নিচু শ্ৰেণীর। সে আমাদের বলেছে তার সাথে ভাঁওতাবাজি করা হয়েছে। ভাঁওতাবাজি শব্দটা ব্যবহার করা ঠিক নয় এই ছেলেটা সেটা জানে না। তাকে বলা হয়েছিল যে তাকে চিড়িয়াখানা এবং জাদুঘরে নেয়া হবে কিন্তু সেখানে না নিয়ে তাকে আমাদের স্কুলে আনা হয়েছে। ছেলেটির বুদ্ধিমত্তা খুবই কম কারণ সে বুঝতে পারে নাই যে তাকে আসলে কখনোই চিড়িয়াখানা নেয়া হবে না। সে নিম্নাঞ্চলের একজন সাধারণ ছেলে তাকে চিড়িয়াখানায় নেয়ার কোন কারণ নেই–এই অতি সাধারণ বিষয়টাই তার বোঝার কোনো ক্ষমতা নেই। বড় মানুষেরা সব সময়েই আমাদেরকে ন্যায়নীতির কথা বলে কিন্তু তারা নিজেরা সেগুলো বিশ্বাস করে না এবং তারা সেগুলো পালন করে না। আমাদের বুদ্ধিমত্তা চল্লিশ থেকে আশি ইউনিটের ভেতর তাই আমরা এই ব্যাপারগুলো চট করে বুঝে ফেলি। কিন্তু রিকি নামক ছেলেটা সেটা বুঝতে পারে। নাই কারণ তার বুদ্ধিমত্তা খুবই কম।