ক্ৰানা রিকির হাত ধরে ক্লাস ঘরের ভেতরে নিয়ে আসে। ছোট ঘোট চেয়ার-টেবিলে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিকির দিকে তাকিয়ে রইল-রিকি ঠিক কী করবে বুঝতে পারে না। এক ধরনের অস্বস্তি নিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে।
হাসি-খুশি মহিলাটি বলল, তোমাদের মনে আছে এ সপ্তাহে আমরা কী নিয়ে আলোচনা করছিলাম? বুদ্ধিমত্তা! শুরু করেছি মাছ দিয়ে, একটা এঞ্জেল ফিশ আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছি। তারপর ছিল একটা গিরগিটি। শীতল দেহের এক ধরনের সরীসৃপ। এরপর ছিল পাখি, দেখে বোঝা যায় না কিন্তু আমরা আবিষ্কার করেছি পাখির বুদ্ধিমত্তা অনেক। পাখির পরে ছিল বুদ্ধিমত্তার উপরের দিকের একটা প্রাণী, সেটা কুকুর ছানা। সেটাকে নিয়ে আমাদের অনেক মজা হয়েছে। তাই না?
কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে বাচ্চাগুলো হাসি-খুশি মহিলার কথায় সাড়া দিল না। মহিলাটি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কুকুর ছানার পর আমরা এনেছি শিম্পাঞ্জি। তোমাদের বলেছি শিম্পাঞ্জির জিনোম শতকরা নিরানব্বই ভাগ আমাদের মতো কাজেই তার বুদ্ধিমত্তাও অনেকটা আমাদের মতো। শিম্পাঞ্জির পর আমরা এনেছি একটা ছেলে! তোমরা আজকে এই ছেলেটার বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করবে। ঠিক আছে?
এবারেও সামনে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলো হাসি-খুশি শিক্ষিকার কথার উত্তর দিল। মহিলাটি অবিশ্যি সেটি নিয়ে মাথা ঘামাল না, বলল, এই ছেলেটিকে আমরা তোমাদের সাথে রেখে যাচ্ছি। এই ছেলেটির সাথে তোমাদের একটা খুব বড় পার্থক্য আছে। সেটি কী। বলতে পারবে?
পার্থক্যটা কী বাচ্চাগুলো অনুমান করতে পারছিল কিন্তু তবু কেউ উত্তর দিল না। হাসি খুশি মহিলা বলল, পার্থক্যটা হচ্ছে তোমাদের জিনোমে। এই ছেলেটির জিনোম সাধারণ তোমাদের জিনোম অসাধারণ। এই ছেলেটির জিনোম কোনো বৈশিষ্ট্য নেই-তোমাদের আছে। আমি চাই তোমরা সবাই মিলে এই ছেলেটিকে পরীক্ষা কর। তোমরা সারা দিন পাবে, বিকেলে আমি তোমাদের রিপোর্ট নেব। ঠিক আছে?
বাচ্চাগুলো এবারেও হাসি-খুশি মহিলার কথার উত্তর দিল না।
শিক্ষিকা আর ক্রানা চলে যাবার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল। রিকি নিজের ভেতরে এক ধরনের অপমান, ক্রোধ এবং দুঃখ অনুভব করে। তার ছোট জীবনে এর আগে কখনোই সে এরকম অনুভব করে নি। সে কী করবে বুঝতে পারছিল না ইচ্ছে করছিল ছুটে পালিয়ে যেতে, কিন্তু সে জানে তার ছুটে পালিয়ে যাবার কোনো জায়গা নেই। রিকি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘরটা পরীক্ষা করল, ঝকঝকে আলোকোজ্জ্বল একটা ঘর। বড় বড় জানালা, উঁচু ছাদ। ঘরের পাশে নানা ধরনের সৃজনশীল খেলনা। ছবি আঁকার ইজেল, কম্পিউটার, বড় বড় মনিটর এবং যন্ত্রপাতি। সামনে বসে থাকা বাচ্চাগুলোকে সে এবারে লক্ষ করে। সবাই তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। রিকি কী করবে বুঝতে না পেরে বলল, এটা। একটা ভাঁওতাবাজি।
নীল জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলেছ?
আমি বলেছি এটা একটা ভাঁওতাবাজি।
ভাঁওতাবাজি?
হ্যাঁ।
ভাঁওতাবাজি মানে কী?
একটা জিনিস করার কথা বলে অন্য একটা জিনিস করাকে বলে ভাঁওতাবাজি।
কালো চুলের মেয়েটি বলল, তোমার সাথে একটা জিনিস করার কথা বলে অন্য জিনিস করেছে?
হ্যাঁ। রিকি বলল, আমাকে বলেছিল চিড়িয়াখানা নিয়ে যাবে। কিন্তু সেখানে না এনে এখানে এনেছে। ভাঁওতাবাজি করেছে।
লাল চুলের মেয়েটি একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বড়রা সব সময়েই ভাঁওতাবাজি করে। তাই না?
অনেকেই রাজি হয়ে মাথা নাড়ল। কোন বড় মানুষ কার সাথে কী ভাঁওতাবাজি করেছে সেটা নিয়ে সবাই কথা বলতে রু করছিল তখন ছোট ছোট করে ছাঁটা চুলের ছেলেটা বলল, ভালোই হয়েছে তোমাকে চিড়িয়াখানায় নেয় নাই। জায়গাটা খুবই হাস্যকর। খুবই দুর্গন্ধ। বাঘ সিংহ হাতি বাথরুম করে রাখে তো।
ছেলেটার কথা শুনে অনেকেই হেসে উঠল। একজন বলল, কিন্তু চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচাটা অনেক মজার। বানরগুলো অনেক বদরামো করে। দেখে কী মজা লাগে! তাই না?
রিকি বলল, আমি বানরের বাঁদরামো দেখেছি।
কোথায় দেখেছ?
আমাদের বাসা থেকে জঙ্গলে যাওয়া যায়। সেখানে বানর আছে। ছোট একটা। বানরের বাচ্চা আমার খুব বন্ধু।
সাথে সাথে সবগুলো বাচ্চা চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ পর নীল জিজ্ঞেস করল, বানরের বাচ্চা তোমার বন্ধু?
হ্যাঁ।
বানরের বাচ্চা কেমন করে তোমার বন্ধু হল? তুমি বানিয়ে বানিয়ে বলছ। তাই না?
রিকি মুখ শক্ত করে বলল, আমি মোটেও বানিয়ে বানিয়ে বলছি না। আমার সাথে চল, আমি তোমাকে এখনই দেখাব।
বাচ্চাগুলো একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। একজন বলল, কী দেখাবে?
বানরের বাচ্চাটা আমার বন্ধু আমি সেটা দেখাব। আমাকে দেখলেই সেটা আমার কাছে এসে ঘাড়ে বসে। কথা বলে।
কথা বলে? নীল বলল, মিথ্যা কথা।
মোটেও মিথ্যা কথা না।
তোমার সাথে কী কথা বলে?
কিচিমিচি করে বলে, আমি বুঝি না।
বাচ্চাগুলো এতক্ষণ তাদের চেয়ারে বসেছিল, এবারে কয়েকজন উঠে এল, রিকিকে কাছে থেকে দেখল। কালো চুলের মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?
রিকি। তোমার নাম কী?
মাতিষা।
নীল এগিয়ে এসে বলল, আমার নাম নীল।
আমার নাম কিয়া।
আমার নাম লন- হঠাৎ করে সবাই একসাথে নিজের নাম বলতে শুরু করল, রিকি খুক করে হেসে বলল, আমি তোমাদের সবার নাম মনে রাখতে পারব না।