রিশ সুপের বাটি থেকে এক চামচ গরম সুপ মুখে নিয়ে বলল, বিচিত্র?
হ্যাঁ। চিঠিতে কী লেখা জান?
কী?
দাঁড়াও, আমি পড়ে শোনাই। বলে তিনা একটা কাগজ হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে :
আপনি শুনে আনন্দিত হবেন যে শহরতলির শিশুদের মূলধারার জীবনের সাথে পরিচিত করার লক্ষ্যে আয়োজিত একটি প্রোগ্রামে আপনাদের সন্তানকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। সেই প্রোগ্রামের আওতায় আগামী সপ্তাহে তাকে চিড়িয়াখানা, জাদুঘর এবং একটি স্কুলে পরিদর্শনের জন্যে নেয়া হবে। এই পরিদর্শনের যাবতীয় দায়িত্ব নিম্নলিখিত প্রতিষ্ঠান বহন করবে। যোগাযোগ করার জন্যে বিনীত অনুরোধ করা যাচ্ছে।
রিশ মাথা নেড়ে বলল, ভাঁওতাবাজি।
রিকি খুব মনোযোগ দিয়ে তার বাবা-মায়ের কথা শুনছিল। রিশের কথা শুনে বলল, কেন বাবা? এটা ভাঁওতাবাজি কেন? ভাঁওতাবাজি মানে কী?
যখন একটা কিছু বলা হয় কিন্তু উদ্দেশ্য থাকে অন্য কিছু, সেটা হচ্ছে ভাঁওতাবাজি।
এরা ভাঁওতাবাজি কেন করবে?
পার্বত্য অঞ্চলে যে বড়লোক মানুষগুলো থাকে তারা আসলে অন্যরকম। আমাদের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা কখনোই আমাদের জন্যে ভালো কিছু করে না।
কেন করে না বাবা?
আমাদেরকে তারা তাদের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে না। তাই হঠাৎ করে যদি দেখি তাদের আমাদের বাচ্চাদের জন্যে মায়া উথলে উঠেছে তা হলে বুঝতে হবে এর ভেতরে অন্য একটা উদ্দেশ্য আছে।
তিনা রিকির প্লেটে এক টুকরো রুটি তুলে দিয়ে বলল, তা হলে তুমি এখানে রিকিকে পাঠাতে চাও না?
রিশ আরো এক চামচ সুপ খেয়ে বলল, কেমন করে পাঠাব? সামনের সপ্তাহে আমাদের ফ্যাক্টরির একটা জরুরি চালান সামাল দিতে হবে-আমি কেমন করে রিকিকে নিয়ে যাব?
তিনা বলল, আসলে আমি যোগাযোগ করেছিলাম। মানুষগুলো বলেছে তারাই নিয়ে যাবে, সবকিছু দেখিয়ে ফিরিয়ে দেবে। দুই দিনের প্রোগ্রাম, প্রথম দিন চিড়িয়াখানা আর মিউজিয়াম। দ্বিতীয় দিন স্কুল।
রিশ কোনো কথা না বলে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। রিকি ডাকল, বাবা।
বল।
আমি যেতে চাই বাবা।
যেতে চাস?
হ্যাঁ। আমি কোনোদিন চিড়িয়াখানা দেখি নি।
রিশ বলল, দেখিস নি সেটা খুব ভালো। দেখলে মন খারাপ হয়ে যাবে।
কেন বাবা? মন খারাপ কেন হবে?
তুই যখন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াস তখন দেখেছিস সেখানে পশুপাখিগুলো মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। চিড়িয়াখানায় সেই একই পশুপাখিকে খাঁচায় বন্দি করে রাখে।
তিনা হাসার চেষ্টা করে বলল, তুমি একটু বেশি বেশি বলছ। বনে জঙ্গলে রিকি আর কয়টা পশুপাখি দেখেছে? চিড়িয়াখানায় কত রকম প্রাণী আছে! বাঘ সিংহ হাতি জলহস্তী সাপ কুমির-কী নেই?
রিকি আবার বলল, বাবা আমি চিড়িয়াখানা দেখতে চাই।
রিশ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চিড়িয়াখানা জাদুঘর ঠিক আছে। আমার আসল আপত্তিটা হচ্ছে স্কুলে।
কেন বাবা? স্কুলে আপত্তি কেন?
বড়লোকের ছেলেমেয়েদের স্কুল-দেখে তোর মন খারাপ হবে। তোক তো আমরা স্কুলেই পাঠাতে পারি না-কোনো স্কুলই নেই তোর জন্যে!
রিকি মাথা নাড়ল, না বাবা। আমার মন খারাপ হবে না।
রিশ কিছুক্ষণ রিকির চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, সত্যিই যেতে চাস?
হ্যাঁ বাবা।
ঠিক আছে। যা তা হলে। মনে হয় জীবনে সব রকমেরই অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। হলই না হয় একটা খারাপ অভিজ্ঞতা।
তিনা মৃদু কণ্ঠে বলল, রিশ। তুমি যদি আসলেই না চাও তা হলে রিকিকে পাঠানোর কোনো দরকার নেই। আমরাই কখনো একবার রিকিকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাব হয়।
থাক। যেতে চাইছে যখন যাক।
রিকি খাবার টেবিলে বসে তার সবগুলো দাঁত বের করে হাসল। আনন্দের হাসি।
১১.
গাড়িটা একটা বড় বিল্ডিংয়ের সামনে থামতেই রিকি তার পাশে বসে থাকা ক্ৰানাকে জিজ্ঞেস করল, এটা চিড়িয়াখানা?
ক্ৰানা ইতস্তত করে বলল, না। এটা চিড়িয়াখানা না।
আমাদের আগে না চিড়িয়াখানায় যাবার কথা? তারপর জাদুঘর?
কানা জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, আসলে পরিকল্পনায় একটু পরিবর্তন হয়েছে। দুই দিনের প্রোগ্রাম ছিল সেটাকে একদিনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
তার মানে আমরা চিড়িয়াখানায় যাব না? জাদুঘরে যাব না?
ক্ৰানা শুকনো গলায় বলল, না। আমরা শুধু দ্বিতীয় দিনের প্রোগ্রামে যাব। সেজন্যে এই স্কুলে এসেছি।
রিকির চোখে-মুখে আশা ভঙ্গের একটা স্পষ্ট ছাপ এসে পড়ল, সে সেটা লুকানোর চেষ্টা করল না। ক্রানার দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে আমার বাবা আসলে ঠিকই বলেছিল।
ক্ৰানা ভুরু কুঁচকে বলল, তোমার বাবা কী বলেছিল?
আমার বাবা বলেছিল, আসলে পুরোটা ভাঁওতাবাজি।
ক্রানা ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলেও কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, কেন? ভাঁওতাবাজি কেন হবে?
কেউ যদি একটা জিনিসের কথা বলে অন্য একটা জিনিস করে সেটাকে বলে ভাঁওতাবাজি। তোমরা ভাঁওতাবাজি করেছ।
ক্ৰানা কঠিন গলায় বলল, বাজে কথা বোলা না ছেলে।
আমার নাম রিকি।
ঠিক আছে রিকি। এস আমার সাথে।
রিকি ক্ৰানার পিছু পিছু হেঁটে যায়। সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠে, করিডোর ধরে হেঁটে যায় এবং শেষে একটা বড় ঘরের সামনে দাঁড়ায়। ঘরের ভেতরে মাঝামাঝি বেশ কয়েকটা ছোট ছোট চেয়ার-টেবিল সেখানে রিকির বয়সী ছেলেমেয়েরা বসে আছে। তাদের সামনে হাসি খুশি চেহারার একজন মহিলা কথা বলছিল। ক্রানার সাথে রিকিকে দেখতে পেয়ে থেমে গেল। গলার স্বরে একটা আনন্দের ভাব ফুটিয়ে বলল, এস। এস তুমি, ভেতরে এস। তারপর সামনের ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখ সবাই। আজকে তোমাদের সাথে কে এসেছে। একটা ছেলে। তোমাদের বয়সী একটা ছেলে।