জীববিজ্ঞানী টুহাস বলল, আমি পুরুষ মানুষ, সন্তান জন্ম দিতে হয় না। তাই কষ্টের পরিমাণটুকু জানি না। কিন্তু বিষয়টা আমি বুঝতে পারছি।
গণিতবিদ রিকি বলল, বিবর্তনের কারণে মানুষ হঠাৎ করে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু হাড়ের সংযোগটা মানুষের পুরো ওজন ঠিকভাবে নিতে পারে না। দুটি পা না হয়ে চারটি পা হলে ওজনটা ঠিকভাবে নিতে পারত। মানুষের হাঁটুও খুব দুর্বল।
প্রযুক্তিবিদ রিভিক কম কথা বলে, সে সবাইকে বাধা দিয়ে বলল, তোমরা কেউ এপেনডিক্সের কথা কেন বলছ না? এটা শরীরের কোনো কাজে লাগে না-হঠাৎ হঠাৎ সংক্রমিত হয়ে কী ঝামেলা করে দেখেছ?
রিভিকের কথার ভঙ্গিতে সবাই হেসে উঠল, জীববিজ্ঞানী সুহাস বলল, এটা ঝামেলা দিতে পারে কিন্তু এর রুত্ব কম। এর চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পুরুষ এবং মহিলার জননেন্দ্রীয় এবং এগুলো কোনোভাবেই সঠিক নয়। এর অবস্থান খুবই বিপজ্জনক!
বিজ্ঞানী ফিদা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল মহামান্য কিহি হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিলেন। মৃদু হেসে বললেন, আমি জানি মানবদেহের ডিজাইনের অসম্পূর্ণতা নিয়ে তোমাদের সবারই অনেক কিছু বলার আছে! আমরা ইচ্ছে করলে এটা নিয়ে সারা দিন কথা বলতে পারি। কিন্তু আমি সেটা করতে চাইছি না। আমাদের কেন্দ্রীয় কম্পিউটারে মানবদেহের সীমাবদ্ধতার পুরো তালিকা রয়েছে। তোমরা এখন যা যা বলেছ সেখানে তার বাইরেও আরো অনেক বিষয় আছে। আমি তোমাদের কাছে জানতে চাইছি, আমরা কি প্রাকৃতিক বিবর্তনের ওপর ভরসা করে অপেক্ষা করে থাকব, নাকি আমরা নিজেরা মানবদেহের সীমাবদ্ধতাগুলো মিটিয়ে দেবার চেষ্টা করব?
বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যরা আবার সবাই একসাথে কথা বলতে শুরু করলেন, কিছুক্ষণের মাঝেই তারা অবশ্য থেমে গেলেন। তারপর একজন একজন করে নিজের বক্তব্য বললেন। দীর্ঘ আলোচনার পর বিজ্ঞান আকাদেমি থেকে মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নেয়া হল। বিজ্ঞান আকাদেমি সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিল মানবজাতির জিনোমে আগামী একশ বছরে খুব ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনা হবে যেন একশ বছর পর মানবদেহে আর কোনো সীমাবদ্ধতা না থাকে। মানবদেহ হবে নিখুঁত, যেন তারা ভবিষ্যতে এই পৃথিবীতে অত্যন্ত সফল একটা প্রজাতি হিসেবে টিকে থাকতে পারে। সিদ্ধান্ত নেবার পর মহামান্য কিহি নরম গলায় বললেন, তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ। ভবিষ্যতের মানব আজকের এই সিদ্ধান্তের জন্যে তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।
সবাই মাথা নাড়ল, বিজ্ঞানী ফিদা বলল, আপনার নেতৃত্ব ছাড়া আমরা কখনোই এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম না মহামান্য কিহি।
***
বিজ্ঞান আকাদেমির মহাপরিচালকের সামনে রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা কেন্দ্রের পরিচালক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি মাথা তুলে বললেন, এটি আপনি কী বলছেন মহামান্য কিহি।
আমি এটা ঠিকই বলছি। আমি অনেক চিন্তা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মহামান্য কিহি বললেন, তুমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ কর।
চিকিৎসা কেন্দ্রের পরিচালক বলল, আপনার দেহ সুস্থ এবং নীরোগ। আপনি আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন। আপনি কেন এখনই শীতলঘরে যেতে চাইছেন?
মহামান্য কিহি বললেন, তার দুটি কারণ। প্রথমত, আমি নূতন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে চাই। আমি দীর্ঘদিন বিজ্ঞান আকাদেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছি এখন অন্য কেউ করুক। দ্বিতীয়ত, আমি খুব বেশি বৃদ্ধ হয়ে অচল হবার আগেই শীতলঘরে যেতে চাই। আজ থেকে একশ বছর পর আমি জেগে উঠে পৃথিবীর মানুষকে দেখতে চাই। মানবদেহের সকল অসম্পূর্ণতা আর ত্রুটি দূর করার পর তারা পৃথিবীতে কীভাবে বসবাস করবে আমি সেটা নিজের চোখে দেখতে চাই।
চিকিৎসা কেন্দ্রের পরিচালক বিষণ্ণ গলায় বললেন, আপনি যদি সেটাই চান তা হলে আমরা সেটাই করব। তবে মহামান্য কিহি-পৃথিবীর মানুষ কিন্তু আপনাকে এভাবে হারাতে চাইবে না।
মহামান্য কিহি মৃদু হেসে বললেন, তুমি সেটা নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমাকে একটা শীতলঘরে রাখার ব্যবস্থা কর। আমাকে জাগিয়ে তুলবে আজ থেকে ঠিক একশ বছর পর।
চিকিৎসা কেন্দ্রের পরিচালক মাথা নুইয়ে বলল, আপনার আদেশ আমাদের সবার জন্যে শিরোধার্য।
***
ক্যাপসুলের ভেতর খুব ধীরে ধীরে চোখ খুললেন মহামান্য কিহি। ভেতরে আবছা এবং নীলাভ এক ধরনের আলো। মাথার কাছে কোনো একটা পোর্ট থেকে শীতল বাতাস বইছে, সেই বাতাসে এক ধরনের মিষ্টি গন্ধ। চোখের কাছাকাছি একটা প্যানেল সেখানে সবুজ আলোর একটা সংকেত, ছোট মিটারটিতে দেখাচ্ছে পৃথিবীতে এর মাঝে একশ বছর কেটে গেছে। মহামান্য কিহি শান্ত হয়ে শুয়ে রইলেন, তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিছুক্ষণের মাঝেই সচল হয়ে উঠবে তখন তিনি এই ক্যাপসুলের ভেতর থেকে বের হয়ে আসবেন। তিনি নিজের ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করতে থাকেন।
মহামান্য কিহি যখন ক্যাপসুল খুলে বের হয়ে এলেন তখন পৃথিবীতে সূর্য ঢলে পড়ে বিকেল নেমে এসেছে। তিনি সুরক্ষিত ঘরের ভারী দরজা খুলে বের হয়ে আসতেই বাইরের সতেজ সবুজ পৃথিবীর ঘ্রাণ অনুভব করলেন। চারপাশে বড় বড় গাছ, ঘাস উঁচু হয়ে আছে ওপরে নীল আকাশে সাদা মেঘ। তিনি কান পেতে পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে পেলেন, তার বুকের ভেতর তিনি এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করলেন, ফিসফিস করে নিজের মনে বললেন, আহা! এই পৃথিবীটা কী অপূর্ব। সৃষ্টিকর্তা তোমাকে ধন্যবাদ, আমাকে মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে পাঠানোর জন্যে!