উঁহু। বিশ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, তোর মা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী মানুষ।
কেন বাবা? মা কেন সাহসী?
তোর মা যদি সাহস না করত তা হলে তোর জন্মই হত না।
মায়ের সাহসের সাথে তার জন্ম নেয়ার কী সম্পর্ক রিকি সেটা ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু সে সেটা বুঝতে দিল না। গম্ভীরভাবে এমনভাবে মাথা নাড়ল যেন সে এটাও বুঝে ফেলেছে।
রিশ একটা বড় লগি দিয়ে ভেলাটাকে ধাক্কা দিতেই ভেলাটা পানিতে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যায়। রিকি বাবার পা ধরে অবাক হয়ে হ্রদের সুবিস্তৃত পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। মাথার উপর কিছু গাঙচিল উড়ছে, পানির ভেতর থেকে একটা শুশুক হঠাৎ লাফিয়ে পানি ছিটিয়ে চলে যায়। দূরের বন থেকে কোনো একটা প্রাণী করুণ স্বরে ডেকে ডেকে যায়। রিকি এক ধরনের মুগ্ধ বিষয় নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
হ্রদের স্বচ্ছ পানির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেরিকি হঠাৎ দেখে পানির নিচে ডুবে থাকা ঘরবাড়ি। দেখে মনে হয় যেন একটা স্বপ্নরাজা– তার মায়ের রূপকথার গল্পের সেই মৎস্যকন্যার নগরী। সে অবাক হয়ে বলল, বাবা! পানির নিচে কার বাড়ি?
একসময় মানুষের ছিল। এখন ডুবে গেছে।
কেন ডুবে গেছে বাবা?
পানি বেড়ে গেছে সেজন্যে ভুলে গেছে।
পানি কেন বেড়ে গেছে বাবা?
যারা পৃথিবীটা ভোগ করে তাদের লোভের জন্যে পৃথিবীর পানি বেড়ে গেছে। পৃথিবীটা ধীরে ধীরে গরম হয়ে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে গিয়েছে তো সেজন্যে পৃথিবীর পানি বেড়ে যাচ্ছে।
মানুষের লোভের জন্যে কেন মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাবে রিকি সেটাও পরিষ্কার বুঝতে পারল না কিন্তু সেটা নিয়েও সে মাথা ঘামাল না-গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল যেন সবকিছু বুঝে ফেলেছে। বড়দের অনেক কথাই সে সব সময় বুঝতে পারে না, কিন্তু সেটা নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। এখন সে শুধু শুনে যায়-বড় হলে নিশ্চয়ই বুঝবে।
কিছুক্ষণ পর দেখা গেল রিশ খালি গায়ে ভেলার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। রিকি নগ্নদেহে ভেলার ওপর থেকে হ্রদের নীল পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মাছের মতো সাঁতার কেটে হ্রদের নিচে ডুবে থাকা প্রাচীন নগরীর কাছে পৌঁছে সেটাকে সে দেখার চেষ্টা করে! পৃথিবীতে এত রহস্য ছড়িয়ে আছে, একটি জীবনে সে সব রহস্য দেখতে পারবে? বুঝতে পারবে?
রিকির ছোট মাথাটাতে এই বয়সে কত বড় বড় ভাবনা খেলা করে–সে যখন বড় হবে তখন তার কী হবে?
০৯.
প্রতিভাবান শিশুদের বিশেষ স্কুলের প্রিন্সিপাল কেটি মধ্যবয়সী হালকা পাতলা একজন মহিলা। সে তার সহকারী ক্রানাকে জিজ্ঞেস করল, স্কুল বাসটা কি এসেছে?
ক্রানা বলল, এসেছে কেটি।
সব ছাত্রছাত্রী বাস থেকে নেমেছে?
নেমেছে।
ক্লাস ঘরে ঢুকেছে?
ক্রানা বলল, হ্যাঁ ঢুকেছে। ক্লাস টিচার সবাইকে নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে।
প্রিন্সিপাল কেটি বলল, চমৎকার!
ক্রানা বলল, আচ্ছা কেটি, তুমি প্রত্যেক দিনই এই ব্যাপারটা নিয়ে এত দুশ্চিন্তার মাঝে থাক, ব্যাপারটা কী?
ব্যাপার কিছুই না-কিন্তু বুঝতেই পারছ, এই স্কুল বাসে করে যে বাচ্চাগুলো আসে তাদের বাবা মায়েরা হচ্ছে-দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ! কাজেই বাচ্চাগুলো ঠিকমতো পৌঁছাল কি না সেটা খুবই জরুরি একটা ব্যাপার। তার থেকেও জরুরি ব্যাপার কী জান?
কী?
এই বাচ্চাগুলোর সবাই হচ্ছে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে ডিজাইন করা বাচ্চা। প্রতিভার স্কেলে কেউ চল্লিশের কম নয়। বিশ্বাস কর আর নাই কর একজনের পয়েন্ট আশি! এই বাচ্চাগুলো সবাই মিলে যদি একসাথে কিছু পরিকল্পনা করে আমাদের সাধ্যি নেই সেটা ঠেকানো!
ক্ৰানা অবাক হয়ে বলল, কী পরিকল্পনা করবে?
জানি না।
এরা তো ছোট বাচ্চা, বয়স সাত আট মাত্র!
জানি। কিন্তু এরা সবাই অসাধারণ। এরা বড়দের মতো চিন্তা করতে পারে। বলতে পার ছোট বাচ্চাদের শরীরে কিছু বড় মানুষ আটকা পড়ে আছে। কোনো কারণে যদি বিগড়ে যায় কিছু একটা করতে চায় আমরা কোনোভাবে ঠেকাতে পারব না।
ক্রানা হেসে বলল, তুমি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছ কেটি। এটা কোনোদিনই হবে না। এই বাচ্চাগুলো শুধু শুধু কেন বিগড়ে যাবে?
প্রিন্সিপাল কেটি বলল, আমি জানি আমি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছি। কিন্তু আমার মনে হয় একটু সতর্ক থাকা ভালো। হঠাৎ কী মনে করে প্রিন্সিপাল কেটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল বাচ্চাগুলো একটু দেখে আসি।
বিল্ডিংয়ের এক কোনায় বড় একটা রুমের মাঝামাঝি ঘোট ঘোট চেয়ার-টেবিলে বারো জন ছোট ছোট ছেলেমেয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। তাদের সামনে একটা বড় অ্যাকোয়েরিয়াম, সেখানে একটা বড় এঞ্জেল ফিশ। অ্যাকোয়েরিয়ামের পাশে একজন হাসি খুশি শিক্ষিকা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। প্রিন্সিপাল কেটি আর তার সহকারী ক্ৰানাকে দেখে কথা থামিয়ে তাদের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, কী খবর কেটি? কী মনে করে আমাদের ক্লাস রুমে?
প্রিন্সিপাল কেটি বলল, অনেক দিন আমি বাচ্চাদের দেখি না। ভাবলাম আজ একনজর দেখে আসি। কেমন আছে সবাই?
হাসি-খুশি শিক্ষিকা বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরাই বল তোমরা কেমন আছ?
কালো চুলের একটা মেয়ে বলল, আমরা তো ভালোই আছি–আমাদের দুশ্চিন্তা আমাদের মায়েদের নিয়ে!
প্রিন্সিপাল কেটি চোখ বড় বড় করে বলল, কেন? তোমাদের মায়েদের নিয়ে দুশ্চিন্তা কেন?