রিশ মোটর বাইকটা থামিয়ে ঠেলে একটা গাছে হেলান দিয়ে বলল, বাকি রাস্তা হেঁটে যেতে হবে। পারবি না বাবা রিকি?
রিকি মাথা নেড়ে বলল, পারব। তারপর দাঁত বের করে হেসে যোগ করল, আর যদি না পারি তা হলে তুমি আমাকে ঘাড়ে করে নেবে!
রিশ মাথা নেড়ে বলল, উঁহু! তুই এখন বড় হয়েছিস-তোকে এখন মোটেও ঘাড়ে করে নেয়া যাবে না!
কেন বাবা? বড় হলে কেন ঘাড়ে নেয়া যায় না?
সেটাই হচ্ছে নিয়ম। যত বড় হবি ততই সবকিছু নিজে নিজে করতে হয়।
রিকি মাথা নেড়ে গম্ভীর হয়ে বলল, আমি সবকিছু নিজে নিজে করি বাবা।
আমি জানি। রিশ বলল, নিজে নিজে করলেই নিজের ওপর বিশ্বাস হয়। সেইটার নাম আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস যদি কারো থাকে তা হলে সে সবকিছু করে ফেলতে পারে। আর যদি আত্মবিশ্বাস না থাকে তা হলে সে জীবনে কিছুই করতে পারে না।
রিশ কী বলছে রিকি সেটা ঠিক করে বুঝতে পারল না। কিন্তু সে সেইটা তার বাবাকে বুঝতে দিল না। সবকিছু বুঝে ফেলেছে সে রকম ভান করে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়তে থাকল।
বাবা আর ছেলের ছোট দলটি কিছুক্ষণের মাঝেই রওনা দিয়ে দেয়। রিশের পিঠে হ্যাঁভারসেক। সেখানে খাবারের প্যাকেট, পানীয় আর কিছু যন্ত্রপাতি। রাস্তা ছেড়ে দিয়ে দুজনেই বনের ভেতর ঢুকে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে তারা একটা পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে এসে পড়ে। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে বাড়িগুলো প্রায় সময়েই ধসে পড়েছে, গাছপালায় ঢেকে গেছে, ঘন লতাগুল্মে সবকিছু ঢাকা। জনমানবহীন এই বাড়িগুলো দেখলে বুকের ভেতর কেমন যেন এক ধরনের কাঁপুনি হয়। লতাগুল্মে ঢাকা বড় একটা পরিত্যক্ত বাড়ি দেখে রিকি হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে গেল। বাবাকে ডেকে বলল, বাবা।
কী হল?
এই বাসাগুলোতে এখন আর মানুষ থাকে না কেন?
মানুষের সংখ্যা কমছে–তাই কেউ থাকে না।
কেন মানুষের সংখ্যা কমছে?
শিশুদের জন্ম না হলে সংখ্যা কমবে না?
শিশুদের জন্ম হচ্ছে না কেন?
রিশ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীটাই তো দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এক ভাগ হচ্ছে বড়লোক। পৃথিবীর সব সম্পদ তাদের হাতে। তারা পৃথিবীটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আরেক ভাগ আমাদের মতো যাদের একটু কষ্ট করে বেঁচে থাকতে হয়।
রিকি গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, বলল, আমাদের মোটেও কষ্ট হচ্ছে না বাবা?
রিশ হেসে ফেলল, বলল, হ্যাঁ। আমাদের মোটেও কষ্ট হচ্ছে না-ঠিকই বলেছিস! কষ্ট ব্যাপারটা আপেক্ষিক।
আপেক্ষিক মানে কী রিকি বুঝতে পারল না। কিন্তু তারপরেও সে গম্ভীর মুখে এমনভাবে মাথা নাড়ল যেন সে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে।
দুজনে যখন হ্রদের পাড়ে পৌঁছেছে তখন সূর্য ঠিক মাথার ওপর। হ্রদের পানিতে সূর্যের আলো পড়ে সেটা ঝিকমিক করছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে রিকি বলল, কী সুন্দর বাবা!
হ্যাঁ। খুবই সুন্দর।
কেন সুন্দর বাবা?
এটা তো কঠিন প্রশ্ন রিকি। কেন যে একটা কিছু দেখে সুন্দর মনে হয় কে জানে! মানুষের ধর্মটাই মনে হয় এরকম। পানি দেখলেই ভালো লাগে। আমাদের শরীরের ষাট সতুর ভাগই তো পানি মনে হয় সেজন্যে।
রিশ এবারেও ব্যাপারটা খুব ভালো বুঝতে পারল না কিন্তু তারপরেও সে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। রিশ লেকের তীরে একটা বড় গাছের ছায়ায় দুই পা ছড়িয়ে বসে রিকির দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে জিজ্ঞেস করল, খিদে পেয়েছে বাবা?
রিকি মাথা নাড়ে। হ্যাঁ বাবা, খিদে পেয়েছে। গলাটাও শুকিয়ে গেছে।
আয়, কাছে আয়। ব্যাগটা খুলে দেখি তোর মা কী দিয়েছে খেতে।
রিকি তার বাবার শরীরে হেলান দিয়ে বসে। রিশ ব্যাগ খুলে খাবারের প্যাকেট আর পানীয়ের বোতল বের করল। প্যাকেট খুলে মাংসের পুর দেয়া পিঠে বের করে দুজনে খেতে শুরু করে। পানীয়ের বোতল থেকে ঢকঢক করে খানিকটা ঝাঁজালো পানীয় খেয়ে রিশ বলল, তুই ঠিকই বলেছিস রিকি।
আমি কী ঠিক বলেছি বাবা?
আমাদের জীবনে কোনো কষ্ট নেই-আমরা খুব আনন্দে আছি।
রিকি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ বাবা। আনন্দে আছি।
.
খাওয়ার পর দুজনে মিলে ভেলাটাকে দাঁড় করানোর কাজে লেগে গেল। হ্রদের তীরে পড়ে থাকা নানা আকারের গাছের গুঁড়িগুলো একত্র করে উপরে নিচে কাঠের দণ্ড মিশিয়ে শক্ত করে বেঁধে নেয়। ভেলাটার মাঝামাঝি একটা ছোট খুপরির মতো তুলে নেয়। পুরো কাজ যখন শেষ হল তখন সূর্য খানিকটা ঢলে পড়েছে। রিশ ভেলাটার দিকে তাকিয়ে বলল, ভেলাটা কেমন হয়েছে রিকি?
খুবই সুন্দর।
আয় এখন এটাকে ভাসিয়ে দিই।
চল বাবা।
রিশ ভেলাটাকে ঠেলে ঠেলে পানিতে নিয়ে আসে। ভেলার বেশ খানিকটা ডুবে গিয়ে উপরের অংশটুকু পানিতে ভাসতে থাকে। রিশ ভেলার উপর দাঁড়িয়ে রিকিকে টেনে উপরে তুলে নেয়। দুজনের ভারে ভেলাটা দুলতে থাকে, গাছের গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে পানি এসে তাদের পা ভিজিয়ে দিল। রিকি আনন্দে হাসতে হাসতে বলল, আমাদের কী সাংঘাতিক একটা ভেলা হল। তাই না বাবা?
হ্যাঁ। আমাদের খুব সুন্দর একটা ভেলা হল।
এই ভেলা করে আমরা কোথায় যাব বাবা?
আমাদের যেখানে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সেখানেই যাব।
আমরা কি পৃথিবীর একেবারে শেষ মাথায় যেতে পারব বাবা!
চাইলে কেন পারব না? যেতে চাস?
আজ না বাবা।
কেন না?
আরেক দিন। মাকে নিয়ে যাব।
রিশ শব্দ করে হেসে ফেলল, বলল, তোর মা এই ভেলাতেই উঠবে না।
ঠিক বলেছ। মা খুব ভিতু তাই না বাবা।