রন আর নিহা তাদের সন্তানের নানামুখী প্রতিভা বিকশিত করার জন্যে যখন যেটা করার প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করে দিল। তার ঘরে ছোট বাচ্চাদের ব্যবহারের উপযোগী কম্পিউটার, তার সাথে নেটওয়ার্ক সংযোগ আর ইলেকট্রনিক মিউজিক সেন্টার। সঙ্গীত সৃষ্টি করার নানা ধরনের ব্যবহারী সফটওয়্যার, ছবি আঁকার জন্যে বিশেষ ইলেকট্রনিক প্যাড, লেখাপড়ার জন্যে তার বয়সোপযোগী নানা ধরনের বই, স্টিমুলেটিং খেলনা এই সব দিয়ে রন আর নিহা তাদের সন্তানের ঘর ভরে ফেলল।
ঠিক একই সময়ে রিশ এবং তিনার সন্তান রিকিও অনেকটা নিজের মতো করেই বড় হতে লাগল। ছেলে হলে তার নাম রাখার কথা ছিল রিকি। নামটি রিশের কাছে একটু বেশি সাদামাটা মনে হলেও সে মেনে নিয়েছে। নীলের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেরকম সুনির্দিষ্ট ছকে বাধা, রিকির জীবন ছিল ঠিক সেরকম অগোছালো। রিকি ঠিক কখন হামাগুড়ি দিতে দিতে দাঁড়িয়ে গেল, ঠিক কখন হাঁটতে শুরু করল এবং কখন কথা বলতে শুরু করল সেটা তিনা কিংবা রিশ কেউই ভালো করে লক্ষ করে নি। নীলের মতো বড় হওয়ার জন্যে সে একশ রকমের উপকরণের মাঝে, নিয়মকানুন আর পদ্ধতির মাঝে বড় হয় নি সেটি সত্যি কিন্তু যে জিনিসটার তার কখনো অভাব হয় নি সেটা হচ্ছে ভালবাসা। বাবা-মায়ের ভালবাসা তো আছেই–দরিদ্র মানুষের শিশুসন্তান পাওয়ার অধিকার নেই বলে পুরো এলাকাতেই শিশু বলতে গেলে রিকি ছিল একা–তাই সে সবার ভালবাসাটাই পেয়েছে। শুধু যে ভালবাসা পেয়েছে তা নয় সে বড় হয়েছে নিম্নাঞ্চলের বনভূমিতে, নদীতে, বিস্তীর্ণ মাঠে, খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থেকে।
তিনা তাকে বর্ণ পরিচয় শিখিয়েছে। তার আগ্রহের কারণে সে লিখতে পড়তে শিখেছে। রিশ তাকে অল্প কিছু গণিত শিখিয়েছে– জীবনের বাকি জ্ঞানটুকু এসেছে দৈনন্দিন জীবন থেকে। সেই জ্ঞানের জন্যে কোথা থেকেও সে সার্টিফিকেট পাবে না সত্যি কিন্তু তার গুরুত্বটুকু কিন্তু একেবারেই কম নয়। তার বয়সী একজন বাচ্চার জন্যে রিকির অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার রীতিমতো অভাবনীয়। তার দৈনন্দিন একটা দিনের হিসেব নিলেই সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
০৮.
রিকি বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছিল, তার মুখের ওপর এলোমেলো চুল এসে পড়েছে। রিশ তার পিঠে হাত দিয়ে বলল, রিকি বাবা আমার! ঘুম থেকে উঠবি না?
রিকি ঘুমের মাঝে একটু শব্দ করে নড়েচড়ে পাশ ফিরে শুলো। রিশ বলল, কী হল, উঠবি না?
রিকি আবার একটু শব্দ করে অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে রইল। রিশ বলল, সকাল হয়ে গেছে। দেখ কত বেলা হয়েছে।
রিকি আবার একটু শব্দ করল। রিশ বলল, মনে নেই আজ আমাদের হ্রদে যাবার কথা?
সাথে সাথে রিকি চোখ খুলে তাকাল, চোখ পিটপিট করে বলল, হ্রদে?
হ্যাঁ। মনে নেই আজকে আমাদের একটা ভেলা বানানোর কথা?
ভেলা? এবারে রিকির চোখ পুরোপুরি খুলে যায়।
হ্যাঁ বাবা। চট করে উঠে পড়, আমরা বেরিয়ে পড়ি। অনেক দূর যেতে হবে।
একটু আগেই যাকে ঠেলেঠুলে তোলা যাচ্ছিল না, এবারে সে প্রায় তড়াক করে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল! কিছুক্ষণের মাঝেই সে হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে এসে বসে। তিনা তার প্লেটে এক টুকরো রুটি আর এক মগ দুধ দিয়ে বলল, নে খা।
রিকি দুধের মগ হাতে নিয়ে বলল, এটা কীসের দুধ মা? এটা কি কৃত্রিম না খাঁটি?
তিনা মাথা নেড়ে বলল, ও বাবা! ছেলের শখ দেখ, সে খাঁটি দুধ খেতে চায়। পৃথিবীতে খাঁটি দুধ কি পাওয়া যায় এখন?
কেন মা? খাঁটি দুধ কেন পাওয়া যায় না?
ফ্যাক্টরিতে কত সহজে কৃত্রিম দুধ তৈরি করে-কে এখন খাঁটি দুধের জন্যে গরুর পিছনে পিছনে ছুটবে?
একজন মানুষ খাঁটি দুধের জন্যে একটা গরুর পিছনে পিছনে ছুটছে দৃশ্যটা রিকির বেশ পছন্দ হল। সে হিহি করে হেসে বলল, গরুর পিছনে ছুটলে কী হয় মা?
যখন কোথাও একটা গরু দেখবি তখন তার পিছু ছুটে ছুটে দেখিস কী হয়?
রিশ তার শুকনো রুটি চিবুতে চিবুতে বলল, রিকি বাবা, খাবার সময় তুই যদি এত কথা বলিস তা হলে খাবি কেমন করে?
রিকি রুটির টুকরোটা দুধে ভিজিয়ে নরম করে মুখে পুরে দিয়ে বলল, আমরা যদি নাক দিয়ে না হলে কান দিয়ে খেতে পারতাম তা হলে কী মজা হত তাই না বাবা।
রিশ ভুরু কুঁচকে বলল, তা হলে কেন মজা হত?
তা হলে আমরা একই সাথে কথাও বলতে পারতাম। খেতেও পারতাম!
তিনা বলল, তোর তো কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না! যে মুখ দিয়ে খাচ্ছিস সেই মুখ দিয়েই তো সমানে বকবক করে যাচ্ছিস!
.
কিছুক্ষণের মাঝেই রিকি তার বাবার হাত ধরে বের হল। যাবার আগে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, মা, তুমি আমাদের সাথে কোথাও যেতে চাও না কেন?
আমিও যদি তোদের পিছু পিছু বনে জঙ্গলে পাহাড়ে টিলায় নদী বিল হ্রদে ঘোরাঘুরি করতে থাকি তা হলে এই সংসারটা দেখবে কে?
কাউকে দেখতে হবে না মা, তুমিও চল। দেখবে কত মজা হবে।
রক্ষে কর। গ্লাইডারে করে পাহাড় থেকে লাফিয়ে আকাশে উড়ে বেড়ানোর মাঝে তোরা বাবা-ছেলে অনেক মজা পাস-আমি কোনো মজা পাই না! বর্ণনা শুনেই ভয়ে আমার হাত-পা শরীরের মাঝে সেঁধিয়ে যায়!
রিকি হিহি করে হেসে বলল, মা! তুমি যে কী ভিতু! আমি তোমার মতো কোনো ভিত মানুষ কখনো দেখি নি!
রিকি মোটর বাইকের পিছনে বসে রিশকে শক্ত করে ধরতেই রিশ প্যাডেলে চাপ দেয়। প্রায় সাথে সাথেই গর্জন করে মোটর বাইকটা ছুটে চলতে থাকে। দেখতে দেখতে তারা শহর পার হয়ে শহরতলিতে চলে এল। শহরতলি পার হতেই রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো হতে শুরু করে। রাস্তার দুই পাশে পরিত্যক্ত বাড়িঘর, গাছপালায় ঢেকে আছে। আরো কিছুদূর যাবার পর রাস্তাটা আরো খারাপ হয়ে গেল। খানাখন্দে বোঝাই, জায়গায় জায়গায় বুনো গাছ ঝোঁপঝাড় উঠে গেছে। মোটর বাইক দিয়েও আর যাবার উপায় নেই।