কী?
আমার মনে হয় প্রাচীনকালের নিয়মটাই ভালো ছিল। তখন মায়েরা তাদের সন্তানকে নিজের ভেতর ধারণ করত। তাকে পূর্ণ মানবশিশু হিসেবে জন্ম দিত।
রন শব্দ করে হেসে বলল, একজন পূর্ণাঙ্গ শিশুকে জন্ম দেয়া কত কঠিন তুমি জান? সেটি কী ভয়ংকর যন্ত্রণা তুমি জান?
কিন্তু একসময় তো পৃথিবীর সব শিশু এভাবেই জন্ম নিত!
একসময় আরো অনেক কিছু হত নিহা। মহামারী হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যেত। প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নিত। মানসিক রোগীকে চারদেয়ালের ভেতর বন্ধ করে রাখা
নিহা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার সন্তানকে জন্ম দিয়ে নিজেকে কেমন জানি খালি খালি মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কী যেন হারিয়ে গেল।
ওটা কিছু নয়। রন নিহার হাত ধরে বলল, ডাক্তার বলেছে শরীরে হরমোনের তারতম্য থেকে এটা হয়। সব ঠিক হয়ে যাবে।
নিহা কোনো কথা না বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। ঠিক কী কারণ জানা নেই তার কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
০৫.
তিনার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। রিশের মুখ ভয়ার্ত এবং রক্তশূন্য। দুই হাতে শক্ত করে সে তিনার একটা হাত ধরে রেখেছে। হঠাৎ চমকে উঠে বলল, ঐ যে-শব্দ হল না? মনে হয় ডাক্তার এসে গেছে।
তিনার যন্ত্রণাকাতর মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠল। সে বলল, না রিশ। কোনো শব্দ হয় নি। কোনো ডাক্তার আসে নি। আমি জানি কোনো ডাক্তার আসবে না।
কেন আসবে না?
আসবে না, কারণ আমাদের জন্যে কারো মনে কোনো ভালবাসা নেই, রিশ। তুমি আমাকে বলেছিলে পৃথিবীর মানুষ এখন দুই ভাগে ভাগ হয়েছে-সুখী আর হতভাগা! আমরা হতভাগা দলের।
রিশ কাঁপা গলায় বলল, এখন এভাবে কথা বোলো না তিনা।
ঠিক আছে বলব না। কিন্তু তোমাকে আমার সাহায্য করতে হবে। পারবে না?
পারব।
পৃথিবীর কোটি কোটি মা এভাবে সন্তানের জন্ম দিয়েছে। আমিও দেব।
অবশ্যই দেবে।
কী করতে হবে আমি তোমাকে বলব। তুমি শুধু আমার পাশে থাক।
আমি তোমার পাশে আছি তিনা।
আমি যদি যন্ত্রণায় চিৎকার করি তুমি ভয় পাবে না তো?
রিশ বলল, না। আমি ভয় পাব না।
আমার ব্যথাটা একটু পরে পরেই আসছে। আমার মনে হয় আর কিছুক্ষণের মাঝেই আমি আমার বাচ্চাটার জন্ম দেব।
ঠিক আছে তিনা। তোমার কোনো ভয় নেই। আমি আছি।
আমি জানি তুমি আছ।
তুমি ঠিকই বলেছ তিনা। পৃথিবীর কোটি কোটি মা এভাবে সন্তান জন্ম দিয়েছে। তুমিও পারবে।
তিনা যন্ত্রণার একটা প্রবল ধাক্কা দাঁতে দাঁত কামড় দিয়ে সহ্য করতে করতে বলল, পারব। নিশ্চয়ই পারব।
রিশ অনুভব করে একটু আগে তার ভেতরে যে এক ধরনের অসহায় আতঙ্ক এসে ভর করেছিল সেটা কেটে যাচ্ছে। তার বদলে তার নিজের ভেতর এক ধরনের আত্মবিশ্বাস এসে ভর করছে। নিজের ভেতর সে এক ধরনের শক্তি অনুভব করতে শুরু করেছে। সে পারবে। নিশ্চয়ই সে তিনাকে তার সন্তানের জন্ম দিতে সাহায্য করতে পারবে।
ভয়ংকর যন্ত্রণা ঢেউয়ের মতো আসতে থাকে। তিনা সেই যন্ত্রণা সহ্য করে অপেক্ষা করে। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সে তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তার শরীরের ভেতর বেড়ে ওঠা সন্তানকে পৃথিবীর আলো বাতাসে নিয়ে আসার জন্যে অপেক্ষা করে।
অমানুষিক একটা যন্ত্রণায় তার চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে যেতে চায়। চোখের ওপর একটা লাল পর্দা কাঁপতে থাকে। তিনা কিছু চিন্তা করতে পারে না, কিছু ভাবতে পারে না। পৃথিবীর আদিমতম অনুভূতির ওপর ভর করে সে তার সন্তানকে জন্ম দেয়ার চেষ্টা করে যায়। ভয়ংকর যন্ত্রণায় সে অচেতন হয়ে যেতে চায় তার ভেতরেও চেতনাকে জোর করে ধরে রাখে- যখন মনে হয় সে আর পারবে না ঠিক তখন হঠাৎ করে সমস্ত যন্ত্রণা মুহূর্তের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল এবং পরের মুহূর্তে সে একটি শিশুর কান্নার শব্দ শুনতে পেল। তিনার ঘামে ভেজা সমস্ত শরীর তখন থরথর করে কাপছে। সে হাত তুলে বলল, রিশ, আমার বাচ্চাটাকে আমার কাছে দাও। আমার বুকের মাঝে দাও।
রিশ রক্তমাখা সন্তানটিকে দুই হাতে ধরে সাবধানে তিনার বুকের ওপর শুইয়ে দিল। তিনা দুই হাতে তাকে গভীর ভালবাসায় আঁকড়ে ধরে। রক্ত ক্লেদ মাখা শিশুটি তখনো তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। তিনা জানে এই কান্না কোনো দুঃখের কান্না নয়, কোনো যন্ত্রণার কান্না নয়। পৃথিবীর বাতাস বুকে টেনে নিয়ে বেঁচে থাকার প্রথম প্রক্রিয়া হচ্ছে এই কান্না। সে সুস্থ সবল একটা শিশুর জন্ম দিয়েছে।
তিনা গভীর ভালবাসায় তার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তার এখনো বিশ্বাস হয় না সে তার নিজের শরীরের ভেতর তিলে তিলে গড়ে ওঠা একটা মানবশিশুর দিকে তাকিয়ে আছে। এই মানবশিশুটি একান্তভাবেই তার। তার আর রিশের।
০৬.
ছোট একটা ব্যাসিনেটে একটা শিশু শুয়ে শুয়ে হাত-পা নাড়ছে, নিহা অপলক শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইল। রনের হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, এটি আমাদের সন্তান?
হ্যাঁ। এটি আমাদের সন্তান। দেখছ না কী সুন্দর নীল চোখ, আকাশের মতো নীল, ঠিক যেরকম তুমি বলেছিলে।
নিহা মাথা নাড়ল, বলল, মাথায় এখন কোনো চুল নেই। যখন চুল উঠবে সেটা হবে সোনালি। তাই না?
হ্যাঁ।
আমার এই বাচ্চাটি যখন বড় হবে তখন সে হবে পৃথিবীর সেরা প্রতিভাবান। তাই না?
রন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ সে হবে পৃথিবীর সেরা প্রতিভাবান। সে ছবি আঁকতে পারবে, গণিত করতে পারবে। সে হবে খাঁটি বিজ্ঞানী। সে হবে সুদর্শন, সুস্থ সবল নীরোগ। মনে নেই উগুরু বলেছে সে আমাদের একটা সার্টিফিকেট দেবে?