রিশ তিনার হাত ধরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি আমার কাছে কখনোই কিছু চাও নি তিনা। আমার কিছু দেবার ক্ষমতা নেই সে জন্যেই বুঝি চাও নি! এই প্রথম তুমি আমার কাছে কিছু চেয়েছ–আমি তোমাকে কেমন করে না করব?
সত্যি তুমি রাজি হয়েছ?
সত্যি।
মন খারাপ করে রাজি হয়েছ?
না। মন খারাপ করে না। খুশি হয়ে রাজি হয়েছি। তিনা তুমি জান আমি অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছি। এই পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তুমি যদি আনন্দ পাও-আমি তা হলে আনন্দ পাই। তুমি যখন মন খারাপ কর তখন আমার মন খারাপ হয়ে যায়! তুমি যেটা চাইবে, যেভাবে চাইবে সেটাই হবে। সেভাবেই হবে!
তিনা রিশের হাত ধরে রেখে বলল, একদিন ছিলাম শুধু তুমি আর আমি। এখন হব আমরা তিনজন। তুমি আমি আর রিকি।
রিকি?
তিনা লাজুক মুখে হেসে বলল, হ্যাঁ। যদি আমাদের ছেলে হয় তা হলে আমরা তার নাম রাখব রিকি। মেয়ে হলে কিয়া।
রিশ চোখ বড় বড় করে বলল, নাম পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেছে?
হ্যাঁ। নাম পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেছে।
রিশ হাসতে হাসতে তার পানীয়ের গ্লাসটি তুলে নেয়।
০৩.
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি চোখ বড় বড় করে তিনার দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক বার চেষ্টা করে বলল, তুমি কী বলছ? তুমি স্বাভাবিক উপায়ে বাচ্চা জন্ম দেবে?
হ্যাঁ। আমি স্বাভাবিক উপায়ে বাচ্চা জন্ম দেব
তুমি কি জান কেউ স্বাভাবিক উপায়ে বাচ্চা জন্ম দেয় না? যখন ঐণটার বয়স তিন থেকে চার মাস হয় তখনই এটাকে জন্ম দিয়ে হাসপাতালের সেলে তার শরীরে রক্ত সরবরাহ করে তাকে বড় করা হয়?
তিনা মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি। কিন্তু আমি তবুও স্বাভাবিক উপায়ে বাচ্চা জন্ম দিতে চাই।
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি কঠিন গলায় বলল, না। স্বাভাবিক উপায়ে মায়ের বাচ্চা জন্ম দেয়া কী ভয়ংকর কষ্ট তুমি জান না। সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চিকিৎসাবিজ্ঞান এই পদ্ধতি বের করেছে। এই পদ্ধতিতে ভ্রণ হিসেবে বাচ্চার জন্ম দেয়া হয়। দ্রুণটির আকার ছোট বলে মায়ের কোনো কষ্ট হয় না।
তিনা বলল, আমি সেটাও জানি। আমি এই বিষয়গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি।
তা হলে তুমি কেন স্বাভাবিক উপায়ে বাচ্চা জন্ম দেবার কথা বলছ?
দুটি কারণে। প্রথম কারণ হচ্ছে এটাই প্রকৃতির বেছে নেয়া উপায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই নূতন প্রক্রিয়া বের করার আগে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ এই প্রক্রিয়ায় সন্তান জন্ম দিয়েছে কাজেই এটা নিশ্চয়ই একটা গ্রহণযোগ্য উপায়। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে জ্বণ হিসেবে সন্তানের জন্ম দিয়ে হাসপাতালে কৃত্রিম পরিবেশে তাকে বড় করতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন আমরা সেই পরিমাণ অর্থ অপচয় করতে চাই না।
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি ভুরু কুঁচকে বলল, তোমার যদি প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকে তা হলে তুমি কেন সন্তান জন্ম দিতে চাইছ?
সন্তান জন্ম দেবার জন্যে রাষ্ট্রীয় নিয়মে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন আমাদের সেই পরিমাণ অর্থ আছে। কিন্তু আমি কৃত্রিম উপায়ে সন্তানের জন্ম দিতে চাই না। আমি সন্তানকে নিজের শরীরে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধারণ করতে চাই। আমি মনে করি একজন মায়ের সেই অধিকার আছে।
মহিলাটি হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, আমি যদি আগে জানতাম তুমি এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেবে তা হলে আমি কখনোই তোমাকে মা হতে দিতাম না!
তিনা মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি। তাই আমার এই সিদ্ধান্তের কথাটি আগে বলি নি।
তিনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এখন যাই? আমার সন্তান জন্মানোর আগে আগে আমি আসব-তখন হয়তো একজন ডাক্তারের প্রয়োজন হবে।
মহিলাটি কঠিন মুখে বলল, একেবারে না এলেই ভালো। পুরোটাই নিজে নিজে করে ফেলতে পার না?
রিশ এতক্ষণ তিনার পাশে বসেছিল, একটি কথাও বলে নি। এবার সে প্রথম মুখ খুলল, বলল, যদি প্রয়োজন হয় আমরা সেটাও করে ফেলতে পারব। তুমি নিশ্চয়ই জান নিম্নাঞ্চলের দরিদ্র মানুষেরা কিন্তু তোমাদের সাহায্য ছাড়াই বেঁচে আছে!
মহিলাটি কোনো কথা বলল না, রিশ আর তিনা হাত ধরে বের হয়ে যাবার পর মহিলাটি সঁতে দাঁত ঘষে বিড়বিড় করে বলল, পৃথিবীটাকে তোমাদের হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে সেটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবে ততই মঙ্গল। তোমাদের জন্যেও আমাদের জন্যেও।
০৪.
রন নিহার হাত ধরে বলল, তোমার কেমন লাগছে নিহা?
নিহা বলল, ভালো। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমি আমার সন্তানের জন্ম দিয়েছি।
হ্যাঁ, কিন্তু সে এখনো আমাদের সন্তান হয়ে ওঠে নি। সে এখনো একটা ঐণ। ডাক্তারেরা তাকে একটা কাচের জারের ভেতর তরলে ডুবিয়ে রেখেছে। তার শরীরে রক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করছে।
কখন এটা শেষ হবে?
আমি জানি না।
যখন শেষ হবে, তখন কি আমরা তাকে দেখতে পাব?
চাইলে নিশ্চয়ই দেখতে পারব। কিন্তু
কিন্তু কী?
রন ইতস্তত করে বলল, ডাক্তারেরা চায় না জ্বণ হিসেবে আমরা তাকে দেখি। এখনো সে দেখতে মানবশিশুর মতো নয়। এখন তাকে দেখলে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
নিহা বলল, আমার নিজের সন্তানকে দেখে আমার মোটেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে না।
রন নিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, নিশ্চয়ই হবে না। তবুও আমার মনে হয় আমরা ছয় মাস পরেই তাকে দেখি। তখন সে সত্যিকারের মানবশিশু হয়ে যাবে।
নিহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার সন্তান আমার শরীরের ভেতর বড় হচ্ছিল, সেটা চিন্তা করেই আমি নিজের ভেতর এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করেছি। এখন সে আমার শরীরের ভেতরে নেই তাকে দেখতেও পাব না-চিন্তা করে মন খারাপ লাগছে। আমার কী মনে হয় জান?