তিনা বলল, আমিও তাই চাই। তুমি যেন সব সময় তোমার মতো থাক কথা বলতে বলতে হঠাৎ তিনা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
রিশ তার পানীয়ে চুমুক দিয়ে বলল, কী হল তিনা, তুমি অন্য কিছু ভাবছ?
তিনা রিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ রিশ, আমি আজকে তোমাকে একটা বিশেষ কথা বলার জন্যে এখানে ডেকে এনেছি।
বিশেষ কথা? বিশ সোজা হয়ে বসে বলল, আমাকে বলবে?
হ্যাঁ।
কী কথা?
তিনা দুর্বলভাবে একটু হেসে বলল, আমি একটা সন্তানের জন্ম দিতে চাই। আমি মা হতে চাই।
রিশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তিনার দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে দেখে মনে হল তিনা কী বলেছে সেটা সে বুঝতে পারে নি। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, তু-তুমি সন্তান জন্ম দিতে চাও? আমার আর তোমার সন্তান?
হ্যাঁ। তিনা এবার বেশ জোর দিয়ে বলল, আমার আর তোমার সন্তান।
কিন্তু সেটা তো অসম্ভব। সন্তান জন্ম দিতে হলে অনেক কিছু থাকতে হয়। আমাদের কিছু নেই-আমাদের কখনো অনুমতি দেবে না!
দেবে।
দেবে?
হ্যাঁ। বিয়ের পর থেকে আমি একটু একটু করে ইউনিট জমাচ্ছি-একজন সন্তান চাইলে তার ব্যাংকে যত ইউনিট থাকতে হয় আমার সেটা আছে!
রিশ চোখ কপালে তুলে বলল, সত্যি?
তিনা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ সত্যি। সে একটু এগিয়ে রিশের হাত স্পর্শ করে বলল, রিশ, আমি তোমাকে কখনো ভালোমন্দ খেতে দিই নি। ভালো পোশাক কিনতে দিই নি। আমরা কখনো কোথাও বেড়াতে যাই নি। কখনো আমি কোনো প্রসাধন কিনি নি। কোনো গয়না কিনি নি-দাঁতে দাঁত কামড়ে আমি শুধু ইউনিট জমিয়ে গেছি। দিনের পর দিন রাতের পর রাত আমি ওভারটাইম কাজ করেছি। আমি তোমাকে দিয়ে ওভারটাইম করিয়েছি। যখন অসুখ করেছে তখন ডাক্তারের কাছে যাই নি। উৎসব আনন্দে কাউকে কোনো উপহার দিই নি-যক্ষের মতো ইউনিট জমিয়ে গেছি! তুমি বিশ্বাস করবে কি না আমি জানি না আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এখন দশ হাজার ইউনিট জমা হয়েছে-আমরা এখন সন্তানের জন্যে আবেদন করতে পারি।
দশ হাজার?
হ্যাঁ, দশ হাজার!
কিন্তু রিশ ইতস্তত করে বলল, কিন্তু…
কিন্তু কী?
শুধু সন্তান জন্ম দিলেই তো হবে না। তাকে মানুষ করতে হবে না?
হ্যাঁ। তিনা মাথা নাড়ল, অবশ্যই সন্তানকে মানুষ করতে হবে। তুমি আর আমি মিলে আমাদের সন্তানকে মানুষ করতে পারব না? আদর দিয়ে ভালবাসা দিয়ে স্নেহ দিয়ে।
তিনা, তুমি তো খুব ভালো করে জান এখন সন্তান জন্ম দেবার আগে সবাই জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারের কাছে যায়। তারা সুস্থ সবল নীরোগ প্রতিভাবান সন্তান ডিজাইন করে দেয়। লক্ষ লক্ষ ইউনিট খরচ করে সেই সব প্রতিভাবান সন্তানেরা জন্ম নেয়। তারা বড় হয়ে বিজ্ঞানী হয় ইঞ্জিনিয়ার হয়। কবি-সাহিত্যিক লেখক হয়! আমাদের সন্তান তো সেরকম কিছু হবে না–সে হবে খুব সাধারণ একজন মানুষ-
তিনা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমাদের সন্তান হবে খুব সাধারণ একজন মানুষ। ঠিক আমাদের মতো। আমার মতো আর তোমার মতো। সে আমাদের সাথে থাকবে আমরা তাকে বুক আগলে বড় করব। বড় হয়ে আমাদের মতো কোনো ফ্যাক্টরিতে চাকরি করবে। যদি সে ছেলে হয় তা হলে টুকটুকে একজন মেয়েকে বিয়ে করবে-আমরা উৎসবের দিন উপহার নিয়ে তাদের দেখতে যাব। যদি মেয়ে হয় সে বড় হয়ে তোমার মতো একজন সুদর্শন হৃদয়বান মানুষ খুঁজে নেবে-তারা উৎসবের দিন আমাদের দেখতে আসবে।
রিশ তার পানীয়ের গ্লাসটা টেবিলে রেখে বলল, তিনা, তুমি কি জান তুমি কী সাংঘাতিক কথা বলছ? একটি সন্তান কত বড় দায়িত্ব তুমি জান? শুধু বেঁচে থাকার জন্যে আমি আর তুমি কত কষ্ট করি তুমি ভেবে দেখেছ? সেই কঠোর পৃথিবীতে তুমি একটা শিশু আনতে চাইছ? যেই শিশুর জন্ম হবে একেবারে অতি সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে। জীবনের প্রতিটি পদে তাকে অবহেলা করা হবে। সে স্কুলে ঢুকতে পারবে না-যদি বা ঢুকে সে পাস করতে পারবে না। শিক্ষা নিতে পারবে না-বন্ধুরা তাকে তাচ্ছিল্য করবে। শিক্ষকরা অবেহলা করবে। বড় হবে এক ধরনের হীনম্মন্যতা নিয়ে। তার জন্যে জীবনের কোনো সুযোগ থাকবে না-কোনো আশা থাকবে না-কোনো স্বপ্ন থাকবে না। কে জানে হয়তো তোমার কিংবা আমার কোনো একটা ব্যাধি তার শরীরে ঢুকে যাবে। হয়তো
তিনা বাধা দিয়ে বলল, এভাবে বোলো না রিশ। আমাদের সন্তান হবে ঠিক তোমার আর আমার মতো। আমরা যেরকম স্বপ্ন দেখি সে ঠিক সেরকম স্বপ্ন দেখবে। আমরা যেরকম কঠিন একটা জীবনে যুদ্ধ করতে করতে একজন আরেকজনের ভেতরে সাহস খুঁজে পাই সেও সেরকম সাহস খুঁজে পাবে! আমাদের সন্তান সাধারণ একজন মানুষ হয়ে বড় হবে। কিন্তু তাতে সমস্যা কী? একসময় কি সাধারণ মানুষ এই পৃথিবীকে এগিয়ে নেয় নি!
রিশ বিষণ্ণ মুখে বলল, কিন্তু তিনা এখন সেই পৃথিবী নেই। এখন পৃথিবীর মানুষ পরিষ্কার দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। যাদের অর্থবিত্ত আছে, তারা একভাগ। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে প্রতিভাবান, বুদ্ধিমান। অন্যভাগ হতদরিদ্রতারা কোনোমতে শুধু টিকে থাকে। তারা পৃথিবীর সৌভাগ্যবান মানুষের জীবনের আনন্দটুকু নিশ্চিত করার জন্যে দিন থেকে রাত অবধি পরিশ্রম করে আমি সেই জীবনে একজন শিশুকে আনতে চাই না তিনা। আমার নিজের সন্তানকে সেই কঠোর কঠিন একটা জীবন দিতে চাই না
তিনা রিশের দুই হাত জাপটে ধরে বলল, রিশ! তুমি না কোরো না। দোহাই তোমার-আমি সারা জীবন স্বপ্ন দেখেছি আমার একটা সন্তান হবে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরব। সে আমার বুকের ভেতর ছোট ছোট হাত-পা নেড়ে খেলা করবে। দাঁতহীন মাঢ়ী দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসবে। আমি তাকে কোলে নিয়ে গান গেয়ে ঘুম পাড়াব। আমি তার জন্যে ছোট ছোট জামা বানাব। সেই লাল টুকটুকে জামা পরে সে খিলখিল করে হাসবে। তুমি না কোরো না রিশ তুমি না কোরো না।