এখানে দাঁড়িয়ে গল্প শোনার প্রয়োজন কি? চলুন যাই। শুকনো কাপড় পরি। চা খেতে খেতে আপনার গল্প শুনি।
না, তুমি এখানে দাঁড়িয়েই গল্প শুনবে।
আপনার ঠাণ্ডা লেগে যাবে। ইতিমধ্যে লেগে গেছে বলে আমার ধারণা।
ঠাণ্ডা লাগুক আর না লাগুক—এখানে দাঁড়িয়ে তুমি গল্প শুনবে।
স্যার বলুন।
আমার শৈশবের একটা ঘটনা। আমার দূর সম্পর্কের এক খালাতো ভাই ছিল। রমিজ নাম। বার-তের বছর বয়স। এক বর্ষাকালে সে জাম পাড়ার জন্যে জাম গাছে উঠল। বর্ষাকালে জাম গাছ থাকে পিছল…
স্যার, কিছু মনে করবেন না। আপনি নিজেও কিন্তু আপনার দারোয়ান হরমুজ মিয়ার মতো বেশি কথা বলছেন—মূল ব্যাপারটা বলতে দেরি করছেন।
রমিজ গাছে উঠল…পিছলে পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যথা পেল। ঘণ্টাখানিক অজ্ঞান হয়ে রইল মাথায় পানি-টানি ঢেলে তার জ্ঞান ফেরানো হল। জ্ঞান আসার পরই সে তার মার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে শুরু করল। কথা বলে, হাসে। কিন্তু তার মা বেঁচে নেই। অনেক আগেই মারা গেছেন। অথচ সে এরকম ভাব করছে যেন মা বেঁচেই আছেন। তার সঙ্গে কথা বলছেন। তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তার ওষুধপত্র দিলেন। সে সেরে গেল।
রমিজ সাহেব কি এখনো জীবিত আছেন?
হ্যাঁ আছে। ঢাকা কাস্টমস-এ কাজ করে। প্রচুর পয়সা করেছে মালিবাগে তার দোতলা বাড়ি। বাড়ির নাম কেয়া ভবন। কেয়া হল তার প্রথম স্ত্রীর নাম। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর সে আবার বিয়ে করেছে। সেই বৌয়ের নাম মিতা। এখন শুনছি বাড়ির নাম পালটে মিতা ভবন…
স্যার, আপনি যে বেশি কথা বলছেন সেটা বুঝতে পারছেন?
পারছি।
মূল গল্পে কি ফিরে যাবেন, না যা বলার বলে ফেলেছেন?
না, আসল ব্যাপারটা বলা হয়নি–রমিজ মাথায় ব্যথা পেয়ে তার মৃতা মাকে দেখতে পেয়েছিল। সেটা ছিল তার মনের কল্পনা। ব্যাপারটা ঘটেছে মাথায় ব্যথা পাওয়ার কারণে। আমার বেলাতেও তাই হয়েছে—আমি মাথায় ব্যথা পেয়েছি। ব্যথা পাওয়ার কারণে তোমাকে দেখছি। তুমি হচ্ছ আমার মনের কল্পনা। এর বেশি কিছু না।
যুবক হাসল। মনসুর সাহেব তাঁর হাসি দেখলেন না তবে তার হাসির শব্দ শুনলেন।
শোন যুবক। যুবক না—বলুন, শোন ফিবোনাক্কি।
শোন ফিবোনাক্কি—তুমি আমার কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। তুমি এই মুহূর্তে বিদেয় হবে।
জ্বি আচ্ছা স্যার। শুধু…
শুধু কি?
ঠাণ্ডায় কাহিত হয়েছি। আপনার ঘরে বসে এক কাপ চা খেতে পারলে…
বিদেয় হও বলছি।
জি আচ্ছা স্যার। গেটটা তো বন্ধ করা দরকার। আপনি একা পারবেন না। আপনি ভেতর থেকে ঠেলা দিন। আমি বাইরে থেকে টানি।
মনসুর সাহেব আপত্তি করলেন না। একা তাঁর পক্ষে গেট সরানো আসলেই কষ্টকর।
গেট বন্ধ করে মনসুর সাহেব ভেতর থেকে তালা দিলেন। ছেলেটি গেটের বাইরে থেকে বলল, স্যার, আমি দেয়ালের বাইরেই থাকব। যদি প্রয়োজন মনে করেন।
মনসুর সাহেব কোনো জবাব দিলেন না। নিজের ঘরের দিকে রওনা হলেন।
সমস্ত শরীর ভিজে জবজব
সমস্ত শরীর ভিজে জবজব করছে। কাদায় মাখামাখি হয়েছেন। গা ধোয়া দরকার। কাপড় বদলে শুকনো কাপড় পরা দরকার। তারচেয়েও বেশি যা দরকার তা হচ্ছে গরম এক কাপ চা। আগুন-গরম চা। নেত্রকোনার লোকজন বলে আগুইন্যা চা। যে চা জিভ-মুখ পুড়িয়ে পাকস্থলিতে নেমে যায়। মনসুর সাহেব ক্ষুধার্ত বোধ করছেন। তারচেয়েও হাজারগুণে যা বোধ করছেন তার : নাম ক্লান্তি। মনে হচ্ছে শরীরের প্রতিটি জীবিত কোষ ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তে চাচ্ছে। কেউ কেউ হয়তো এরমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ভেজা কাঠের চুলা এই মুহূর্তে ধরানো সম্ভব নয়। চোঙা দিয়ে ক্রমাগত যুঁ দিতে হবে। তার ফুসফুসে সেই জোর নেই। ছেলেটাকে নিয়ে এলে হত। যুবক ছেলে জোরালো ফুসফুস। আগুন জ্বালালে শরীর আরাম পেত। কোনোমতে চারটা ভাত ফুটাতে পারলে ভাতের উপর ঘি ছড়িয়ে দিয়ে খেয়ে ফেলা যেত। আজিজ খাঁ হরলিক্সের কৌটা ভর্তি এককৌটা ঘি দিয়ে গেছে। গরম ভাত-ঘি, সঙ্গে একটা ভাজা শুকনা মরিচ।
ক্লান্তি লাগছে, ক্লান্তি। তিনি শুয়ে পড়বেন। আরাম করে ঘুমুবেন। তাঁর মতে আজকের রাতের মতো আরামের ঘুম তার আর কোনো দিনও হবে না। এই সুযোগ নষ্ট করা ঠিক হবে না। কাপড় বদলানোর দরকার নেই। ভেজা কাপড়েই শুয়ে পড়বেন।
মনসুর সাহেব ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানার দিকে এগুচ্ছেন। আর তখন শুনলেন। ফিবোনাক্কির গলা—স্যার! স্যার।
দেয়ালের বাইরে থেকেই ডাকছে। তবে ডাকছে তার ঘরের জানালার ঠিক নিচে থেকে। কষ্ট করে উঁকি দিলে দেখতে পাওয়ার কথা। মনসুর সাহেব নিতান্ত অনিচ্ছায় জানালা দিয়ে উঁকি দিলেন—আবছা আবছা একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
কি চাও?
স্যার, আপনি ভেজা কাপড়ে বিছানায় যাবেন না।
আমি কি করি না করি সেটা সম্পূর্ণই আমার ব্যাপার।
ভেজা কাপড়ে ঘুমুতে গেলেই ভয়ংকর ঠাণ্ডা লেগে যাবে। নিওমোনিয়া তো হবেই। আপনার যে বয়স! নিওমোনিয়ার ধকল সামলাতে পারবেন না।
তাতে তোমার কি সমস্যা?
আমার খুব সমস্যা। আপনি যে জটিল অন্ধটি শুরু করেছেন তার শেষটা আমাদের দরকার। আপনি যে কাজটি করতে পারছেন—আমরা তা পারছি না। আপনি কিছু ছোট ছোট ভুল করছেন। সেই ভুলগুলি ধরিয়ে দিলে আপনার জন্যে কাজ সহজ হয়…
আমি কি ভুল করছি?
স্যার, সবই বলব। আমাকে ভেতরে আসতে দিলে ভালো হয়। গেট খুলতে হবে না। আমি দেয়াল বেয়ে উঠে আসব।