প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। খুব কাজেই পড়ল। এত কাছে যে বিদ্যুতের নীল শিখার পাশে পাশে তিনি কমলা শিখাও দেখতে পেলেন। এটা একটা আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। ঝড়ের মধ্যে বের না হলে তিন হাত সামনে বজ্ৰপাত দেখতে পেতেন না। ঘটনাটা বিপজ্জনক তো বটেই। বজ্র উঁচু জায়গায় আঘাত করে। বাঁধে কোনো গাছপালা নেই। উঁচু জায়গা বলতে তিনি। বজ্রটার উচিত ছিল তাঁর উপর পড়া। পড়ল না কেন? প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে। সে কাউকে করুণা করে না। তাঁকে এই করুণা করার মানে কি?
প্রকৃতির এই আচরণে মনসুর সাহেব খানিকটা বিরক্তই হলেন আর তখন দ্বিতীয় বজ্ৰপাত হল—তিনি ছিটকে বাঁধের নিচে পড়ে গেলেন। যখন তাঁর জ্ঞান হল তখননা অঝাের ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। কাদায়-পানিতে তিনি মাখামাখি। শীতে কিংবা অন্য কোনো কারণে তাঁর হাত-পা শক্ত। তিনি কি মারা গেছেন না জীবিত আছেন—এই বোধ স্পষ্ট হচ্ছে না। মারা যাবার সম্ভাবনাই বেশি। শরীরের ভেতর দিয়ে কয়েক লক্ষ ভোল্ট ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। শরীর ভস্ম হয়ে যাবার কথা। তিনি মারা গেছেন এটাও মনে হচ্ছে না। মৃত মানুষের শীত লাগার কথা না। কিন্তু তাঁর শীত লাগছে। ঠকঠক করে শরীর কাঁপছে। মুখের উপর কেউ একজন মনে হয় ঝুঁকে আছে। মানুষ না অন্য কিছু অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না। তিনি বললেন—এখানে কে?
প্রশ্নের জবাব পাবেন মনসুর সাহেব সেই আশা করেননি। কিন্তু জবাব পেলেন। মিষ্টি এবং সহজ গলায় কেউ একজন বলল
–আপনি আমার হাত ধরুন। হাত ধরে উঠে দাঁড়ান।
কে কথা বলছে?
আমি।
আমিটা কে?।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি আমার পরিচয় দেব। তার আগে আপনাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া দরকার।
আমি কি বেঁচে আছি-না-কি?
অবশ্যই বেঁচে আছেন। বাঁধের উপর থেকে নিচে পড়ে ব্যথা পেয়েছেন?
বিদ্যুৎ চমকাল। বিদ্যুতের আলোয় মনসুর সাহেব মানুষটাকে দেখলেন। একুশ-বাইশ বছরের একজন যুবক। শার্ট-প্যান্ট পরে আছে। প্যান্ট খানিকটা গুটানো। কাপড়-চোপড় ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে।
যুবকই তাঁকে টেনে তুলল।
স্যার, আপনি কি হাঁটতে পারবেন?
মনসুর সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, হাঁটতে না পারলে তুমি কি করবে? আমাকে কোলে করে নিয়ে যাবে?
যুবক হেসে ফেলল। মনসুর সাহেব বললেন—এখন কটা বাজে জান?
জ্বি না। আমার সঙ্গে ঘড়ি নেই। স্যার চলুন, আমরা আস্তে আস্তে হাঁটি। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজার কোনো অর্থ নেই। আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে পা ফেলুন।
হাত ধরতে হবে না। আমি হাঁটতে পারব। তোমার নাম কি?
যুবক জবাব দিল না। তুমি করে বলায় সে কি রাগ করল না-কি? নেত্রকোনা অঞ্চলের মানুষ তুমি করে বললে ফট করে রেগে যায়। দীর্ঘদিন মাস্টারির কুফল হল—মুখে তুমি আগে চলে আসে। মৃত্যুর সময় আজরাইলকে ঘরে ঢুকতে দেখলে পুরানো স্কুল মাস্টাররা বলে বসবেও তুমি? জান কবজ করতে এসেছ? আজরাইল তাতে রাগ করলেও এই যুবকের রাগ করার কিছু নেই। তিনি বৃদ্ধ একজন মানুষ। সামনের মাসেই তাঁর রিটায়ার করার কথা। কুড়ি-একুশ বছরের একজন যুবককে তুমি বলার অধিকার তো তার থাকাই উচিত।
তুমি বলায় রাগ করেছ না-কি?
জ্বি না স্যার, রাগ করিনি।
রাগ করনি, তাহলে প্রশ্নের জবাব দিচ্ছ না কেন?
কোন্ প্রশ্ন?
একটু আগে যে জিজ্ঞেস করলাম তোমার নাম কি?
আমার নাম নেই।
নাম নেই মানে? নাম থাকবে না কেন?
আপনি একটা নাম দিয়ে দিন।
তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। নাম নেই বলতে তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছ? তোমার বাবা-মা তোমার কোনো নাম দেননি?
জ্বি না।
বৃষ্টি কমে এসেছে। বাতাস এখনো আছে। এত ঠাণ্ডা বাতাস সারাজীবনে মনসুর সাহেবের গায়ে লাগেনি। পৌষ মাসের বাতাসও এত ঠাণ্ডা থাকে না। এটা হল চৈত্র মাস।
তুমি বলতে চাচ্ছ তোমার বাবা-মা তোমার কোনো নাম রাখেননি?
আমার বাবা-মা নেই।
তাঁরা অল্প বয়সে মারা গেছেন?
স্যার, ব্যাপারটা ঠিক তাও না। বাবা-মার যে ধারণা পৃথিবীর মানুষদের আছে—সেই ধারণা আমাদের জন্যে প্রযোজ্য নয়। আমি এই পৃথিবীর কেউ না।
তুমি এই পৃথিবীর কেউ না?
জ্বি না।
মনসুর মোটেই চমকালেন না। অতিরিক্ত ঠাণ্ডায়—বজ্ৰপাতের মানসিক চাপে তার মাথা কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। এক যুবক ছেলে তাকে বলবে সে এই পৃথিবীর কেউ না আর তিনি তা বিশ্বাস করে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠবেন, তা হয় না।
তুমি আমাকে পেলে কোথায়?
আমি আপনার খোঁজেই এসেছি।
ও আচ্ছা। তুমি কর কি?
স্যার, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
জটিল কথা তো কিছু বলছি না। জানতে চাচ্ছি তুমি কি কর। চাকরি বাকরি কর না এখনো ছাত্র?
আমি একজন ছাত্র।
কোন্ ক্লাসের ছাত্র? কলেজ শেষ করেছ?
স্যার, আপনাদের যেমন পড়াশোনার নানান স্তর আছে—আমার সে রকম নয়…ব্যাখ্যা করতে সময় লাগবে। চলুন আগে বাসায় যাই।
যুবকটি মনসুর সাহেবের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মনসুর সাহেব কিছুটা বিভ্রান্তি বোধ করছেন। মাথা ঝিম ঝিম করছে। বাঁধের উপর থেকে নিচে পড়ে যাবার সময় মাথায় ব্যথা পেয়েছেন। যা ঘটছে তা কি মাথায় ব্যথা পাওয়ার জন্যেই হচ্ছে? ফিবোনাক্কি রাশিমালার কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তা করলে অবশ্য বোঝা যাবে চিন্তাশক্তি ঠিক আছে না তাতে কোনো সমস্যা আছে।
ফিবোনাক্কি রাশিমালার প্রথম বৈশিষ্ট্য কি? প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই রাশিমালার পরপর যে কোনো চারটি সংখ্যা নেয়া হলে প্রথম এবং চতুর্থ সংখ্যার যোগফল, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যার যোগফলের চেয়ে এক কম। যেমন–