ঘটনাটা বরিশালের।
বরিশালের ঠিক না—পিরোজপুর সাবডিভিশনের গোয়ারেখা গ্রামে। আমার নিজের দেখা। অন্যের কাছে শোনা গল্প হলে আপনাদের বলতাম না। তখন ঢাকা মেডিক্যালে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমার ছোটমামা বিয়ে করেছেন গোয়ারেখা গ্রামে। আমাকে একবার পাঠালেন মামিকে পৌঁছে দিয়ে আসতে। আমি ভেবেছি যাব মামিকে পৌঁছে দিয়ে পরদিন চলে আসব। মেডিক্যাল কলেজ খোলা। ইচ্ছা করলেও থাকার উপায় নেই। পৌছার পর এমন বিপদে পড়লাম। শুরু হল লঞ্চ স্ট্রাইক। ঐসব অঞ্চলের কায়দাকানুনই অন্যরকম। একটা কিছু শুরু হলে আর শেষ হয় না। দশদিন ধরে চলল স্ট্রাইক। আমি তিক্ত-বিরক্ত। যার কীভাবে? যোগাযোগের একটাই ব্যবস্থা—লঞ্চ বা স্টিমার। ইচ্ছা করছে সাঁতরে রওনা দিয়ে দেই। এই সময়ের ঘটনা। গোয়ারেখা গ্রামের জঙ্গলে একটা ডেডবডি পাওয়া গেল। কেউ মেরে ফেলে রেখে গেছে। টাটকা ডেডবডি। নাক দিয়ে, মুখ দিয়ে তখনো রক্ত পড়ছে। এক গরুর রাখাল জঙ্গলে গিয়েছিল গরুর খোঁজে—সে-ই ডেডবডি প্রথম দেখল। গ্রামের সমস্ত লোক ভেঙে পড়ল।
অপরিচিত মানুষের ডেডবডি। আগে কেউ কখনো দেখেনি। মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। পরনে নীল লুঙ্গি। গায়ে ফতুয়ার মতো একটা জিনিস। মাদ্রাসার কম বয়েসী। তালেবুল এলেমদের যেমন অল্প কয়েক গোছা দাড়ি থাকে, সেরকম দাড়ি।
পুলিশে খবর দেবে সেই উপায় নেই। স্বরূপকাঠি থানা সতেরো মাইল দূরে। গ্রামের লোকজন পরামর্শ করে জানাজা পড়ে গোর কবর দিয়ে ফেলল। সকাল বেলা কবর দিয়েছে, সন্ধ্যাবেলা পুলিশ এসে উপস্থিত। ওদের নিজেদের স্পিড বোট আছে। ফটফট করে স্বরূপকাঠি থানার সেকেন্ড অফিসার চারজন কন্সটেবল নিয়ে হাজির। এসেই বিরাট হস্থিতম্বি। কেন পুলিশে খবর না দিয়ে ডেডবডি কবর দেয়া হল। এর মধ্যে রহস্য আছে। তিনি কাউকে ছাড়বেন না। প্রয়োজনে গ্রামসুদ্ধ বেঁধে নিয়ে যাবেন।
পয়সা খাওয়ার মতলব আর কি? গ্রাম অঞ্চলে খুনখারাবি হওয়া মানে। পুলিশের জন্যে ঈদ উৎসব। আসামি-ফরিয়াদি দুই তরফ থেকেই স্রোতের মতো টাকা আসতে থাকে।
গ্রামের মুরুঝিরা চাঁদা তুলে হাজার খানিক টাকা সেকেন্ড অফিসার সাহেবকে দিয়ে আপাতত ঠাণ্ডা করল।
ডাব-টাব কেটে আনল। সেকেন্ড অফিসার সাহেব বললেন—গোর খোদাই করে ডেডডি তোল। আমি দেখব। সবাই বলল সন্ধ্যাবেলা এই কাজটা করা ঠিক হবে না।
ভদ্ৰলোক হুংকার দিয়ে বললেন, পুলিশের কাছে আবার সকাল-সন্ধ্যা কি?
কবর খোঁড়া শুরু হল। গ্রামের সব লোক ভেঙে পড়ল। আমিও কৌতূহলী হয়ে গেলাম। দুটা হ্যাজাক বাতি জ্বালানো হয়েছে। অনেকেই এসেছে হ্যারিকেন হাতে।
কবর খুঁড়ে সবাই হতভম্ব। কারণ ডেডবডির গায়ে কাফনের কাপড়টা নেই। ডেডবডি তার কাফনের কাপড় নিজেই খেয়ে ফেলেছে। সবটা খেতে পারেনি—খানিকটা কাপড় মুখ থেকে বের হয়ে আছে…
আড্ডায় অস্ফুট গুঞ্জন উঠল।
দুজন একসঙ্গে বলল, তারপর তারপর?
বজলুর রহমান সিগারেট ধরাতে ধারতে বললেন—পরের ব্যাপার আরো ভয়ংকর। দাঁড়ান বলছি, চা-টা খেয়ে নেই। কথা বলতে বলতে টায়ার্ড হয়ে গেছি।
মনসুর সাহেবের অসহ্য লাগছে। এই গল্পের বাকি অংশ শোনার তার আর। ধৈর্য নেই। তিনি উঠে দাঁড়ালেন—বজলুর রহমান সাহেব! আমি আজ উঠি। আরেকদিন আসব।
আরে বসুন বসুন। চোখটা দেখে দেই। বাতি নেই, দেখবেন কি? গল্পের শেষটা শুনে যান। শেষটা ভয়ংকর। ইচ্ছা করছে না।
মনসুর সাহেব ঘরের বাইরে পা দিলেন। ফোঁটা ফেঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। তিনি দ্রুত হাঁটছেন। তাঁর মন বলছে কী একটা জিনিস যেন বাকি আছে। একটা কিছু ভুল হয়ে গেছে। তিনি সেই ভুল ধরতে পারছেন না। মনের অস্বস্তি দূর হচ্ছে না। ছোটবাজার ছাড়িয়ে যখন কাঁচা পথে উঠে এলেন তখনি নিজের অস্বস্তির কারণ ধরতে পারলেন। ছাতা ফেলে এসেছেন। এখন ফিরে গিয়ে ছাতা আনতে যাবার অর্থ হয় না।
বৃষ্টি কেঁপে আসছে। চারদিকে ঘোর অন্ধকার। তিনি ভিজে সার হয়েছেন। কাগজগুলি না ভিজলেই হল—কাগজগুলির জন্যেই তার দুশ্চিন্তা। চিনি আর লেবু কেনা হয়নি। আজ রাতে লেবুর সরবত খাওয়া যাবে না। তার চেয়েও বড় সমস্যা—ভাত রাঁধতে হবে। ডিম নিশ্চয়ই আছে। ভাত আর ডিমভাজি। রান্না তেমন জটিল নয়—চুলা ধরানোটাই জটিল।
এঁটেল মাটির রাস্তা
এঁটেল মাটির রাস্তা। বৃষ্টি পড়তেই কাদা হয়ে গেছে। জুতা কাদায় আটকে যাচ্ছে। বাতাস দিতে শুরু করেছে। মনসুর সাহেব ঠিক করলেন ছোটবাজারে ফিরে যাবেন। ঝড়-বৃষ্টির ভেতর এতটা পথ যাওয়া বড় ধরনের বোকামি হবে। শিলাবৃষ্টি শুরু হলে মাথা বাঁচানোর উপায় নেই। বৃষ্টির ফোঁটা হিমশীতল। এর মানে হল অনেক উঁচুতে বৃষ্টি তৈরি হচ্ছে যেখানে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কাছাকাছি। চশমার কাচে পানি জমছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না।
ছোটবাজারে ফিরে যাবার ব্যাপারে পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নেবার পরেও মনসুর সাহেব এগুচ্ছেন তাঁর বাসার দিকে। এবং পা বেশ দ্রুত ফেলছেন। ঘোর অন্ধকার। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বলে পথ চলতে অসুবিধা। বিদ্যুৎচমকে কি ফিবোনাক্কি রাশিমালা কাজ করে? প্রথম একবার, তারপর আবার একবার, তারপর পরপর তিনবার।
তিনি মারা নদীর বাঁধের উপর উঠে এলেন। এই রাস্তাটা মোটামুটি ভালো। কাদা নেই। বাঁধের নিচে নৌকা বাঁধা থাকে। আজ কোনো নৌকাও নেই। বাঁধের উপর উঠে ঝড়ের ঝাপ্টা অনুভব করা যাচ্ছে। তিনি কুঁজো হয়ে হাঁটছেন এবং প্রতিমুহূর্তেই তাঁর মনে হচ্ছে এই বুঝি ধাক্কা দিয়ে বাতাস তাকে নদীতে ফেলে দিল।