চা খেয়ে যান স্যার। ঝড়-বাদলের দিন, চা খেলে ভালো লাগবে।
ঝড়-বাদলা কোথায়?
এখনো নাই, তবে স্যার শুরু হবে।
চা খেতে ইচ্ছা করছে না।
একটু খান স্যার। আপনি কিছু না খেয়ে শুধু-মুখে চলে গেলে সাহেব রাগ করবেন। চা আনতে ফ্ল্যাস্ক নিয়ে লোক গেছে। এসে পড়বে।
মনসুর সাহেব বসলেন। বদরুল বলল—আপনার অঙ্কটার বিষয়ে কিছু বলেন স্যার শুনি। শখের একটা অঙ্ক করছেন। শুনেই কেমন লাগে। অঙ্ক আর মানসাঙ্ক এই দুইয়ের নাম শুনলেই এখনো কলিজা কঁপে। তাও ভালো, এখনকার ছাত্রদের মানসাঙ্ক করতে হয় না…মণের দামের বামে ইলেক মাত্ৰ দিলে…ওরে বাপরে, কী জিনিস ছিল! স্যার, আপনার অঙ্কটা কি?
ঐটা হল তোমার ফিবোনাক্কি রাশিমালা নিয়ে একটা কাজ।
বদরুল হতভম্ব হয়ে বলল, কি রাশিমালা বললেন?
ফিবোনাক্কি। ত্ৰয়োদশ শতাব্দীর এক বিখ্যাত গণিতবিদ লিওনার্ডো ফিবোনাক্কি এই রাশিমালা বের করেছিলেন। মরবার সময় তিনি বলে গিয়েছিলেন প্রকৃতির মূল সমস্যা এই রাশিমালাতে আছে।
স্যার, বলেন কি?
মৃত্যুর সময় তিনি খুব আফসোস নিয়ে মারা গিয়েছিলেন।
আফসোস কি জন্যে?
রহস্যময় এক রাশিমালা বের করলেন কিন্তু সেই রাশিমালা নিয়ে কাজ করে যেতে পারলেন না—এই নিয়ে আফসোস। মৃত্যুর সময় চিৎকার করে বলছিলেন–হে ইশ্বর, আমাকে আর মাত্র তিন বছর আয়ু দাওমাত্র তিন…
আহা বেচারা! আর তিন বছর বচলে ফাটাফাটি হয়ে যেত। তাই না স্যার?
মনসুর সাহেব এই কথার কোনো উত্তর দিলেন না। চা এসে গেছে। তিনি চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছেন। ঠাণ্ডা চিনির সরবত। না খেলে বদরুল মন খারাপ করবে বলেই খাওয়া।
ফিক্কি রাশিমালা ব্যাপারটা কি স্যার? ফিল্কি না, ফিবোনাক্কি। আমাদের সাধারণ রাশিমালা তো তুমি জানই।
জানি না স্যার। অঙ্কে আমি মারাত্মক কাঁচা। মেটিকে একচল্লিশ পেয়েছিলাম। অঙ্কের স্যার আমি এত নাম্বার পেয়েছি শুনে কী যে অবাক হয়েছিলেন! আমি স্যার কিছুই জানি না।
মনসুর সাহেব সহজ গলায় বললেন, অবশ্যই জান। ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, …এই হল সাধারণ রাশিমালা।
এটা জানি।
এরকম আরো রাশিমালা আছে, যেমন—শুধু মৌলিক সংখ্যার রাশিমালা ১, ৩, ৫, ৭, ৯, ১১… ফিবোনাক্কি রাশিমালা হল—১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫, ৮৯…
একেবারে বেড়াছেড়া অবস্থা।
না, বেড়াছেড়া না। এই রাশিমালার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাশিমালার প্রতিটি সংখ্যা হল আগের দুটি সংখ্যার যোগফল। যেমন ধর, এই রাশিমালার চতুর্থ সংখ্যা হল পাঁচ। পাঁচ হল ২য় এবং ৩য় সংখ্যার যোগফল। বড়ই রহস্যময় রাশিমালা।
আমি তো স্যার কোনোই রহস্য দেখতে পাচ্ছি না।
তুমি তো অঙ্ক নিয়ে চর্চা কর না, তাই এই রাশিমালার রহস্য ধরতে পারছ। না। এই রাশিমালার ১১ নম্বর সংখ্যা হল ৮৯। রাশিমালার প্রথম সংখ্যা এককে যদি তুমি ৮৯ দিয়ে ভাগ দাও তাহলে আবার এই রাশিমালা দিয়ে আসে।
যেমন…
১/৮৯= .০১১২৩৫৮১৩২১…
বদরুল চোখ বড় বড় করে তাকাল। কিছু না বুঝেই চোখ বড় করল। পাগলা ধরনের লোক আগ্রহ নিয়ে একটা কথা বলছে—সেই সব কথা বিস্মিত হয়ে না শুনলে ভালো দেখায় না। এই কারণেই বিস্মিত হওয়া।
মনসুর সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, প্রকৃতিতে ফিবোনাকি সিরিজের খুব প্রয়োগ দেখা যায়। সূর্যমুখী ফুলের পাপড়ির বিন্যাস এই রাশিমালা অনুসারে হয়। শামুকের যে স্পাইরেল ও এই রাশিমালা অনুসারে হয়। সমুদ্রে এক ধরনের লাল কাঁকড়া থাকে। সেই কাঁকড়া যে সব নকশা বালিতে তৈরি করে তার মধ্যে থাকে ফিবোনাক্কি রাশিমালা…
বলেন কি?
শীতের সময় সাগর পাড়ি দিয়ে অতিথি পাখিরা যে আসে, ওরা ঝাক বেঁধে উড়ে। ঝুকে পাখির সংখ্যা ফিবোনাক্কি রাশিমালায় যে সব সংখ্যা আছে তার বাইরে কখনো হয় না। যেমন ধর, একটা ঝুঁকে ২১ টা পাখি থাকতে পারে, কিন্তু কখনো ২২ বা ২৩টা পাখি থাকবে না। কারণ ২২ বা ২৩ ফিবোনাক্কি রাশিমালায় নেই। ২১ আছে। আজ উঠি বদরুল?
জ্বি আচ্ছা, স্যার। আপনার কাছ থেকে জ্ঞানের কথা শুনে মনটা বড় ভালো হয়েছে।
তুমি তো মনে হয় কিছু বুঝতে পারনি।
স্যার বুঝেছি। আপনি জলের মতো বুঝিয়ে দিয়েছেন। আপনার মতো একজন শিক্ষক পেলে মেট্রিকে অঙ্কে লেটার থাকত। স্যার, ছাতাটা নিয়ে যান। বৃষ্টি নামলো বলে। আচ্ছা স্যার, বৃষ্টির ফোঁটাও কি ফিবোনাক্কি রাশিমালার মতো পড়ে?
মনসুর সাহেব জবাব দিলেন না। তাঁর ক্ষীণ সন্দেহ হল, ছেলেটা তাঁর সাথে রসিকতা করার চেষ্টা করছে।
রাস্তায় নামতেই বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তিনি ডাক্তার বজলুর রহমানের ফার্মেসিতে উঠলেন। ফার্মেসি অন্ধকার। কাটআউট জ্বলে গেছে। মোমবাতি জ্বালিয়ে বজলুর রহমান সাহেব জমিয়ে গল্প করছেন। কয়েকজন আগ্রহী শ্রোতা তাঁকে ঘিরে আছে। টেবিলে মরিচ দিয়ে মাখা মুড়ি। মরিচ এমন ঢেসে দেয়া হয়েছে যে ঘরে পা দিতেই মরিচের গন্ধ নাকে এল।
মনসুর সাহেবকে দেখেই বজলুর রহমান বললেন, স্যার আসুন, মুড়ি খান। হেডস্যার বলেছেন আপনার চোখের সমস্যার কথা। বাতি নেই, চোখ দেখতে পারব না। কাম্পাউন্ডার ইলেকট্রিসিয়ান আনতে গেছে। বাতি আসুক, তারপর চোখ দেখব।
আড্ডার একজন বলল, গল্পটা শেষ করুন।
ভূতের গল্প হচ্ছিল। গল্পে বাধা পড়ায় সবাই খানিকটা বিরক্ত। মনসুর সাহেব এক কোণায় চেয়ারে গুটিগুটি হয়ে বসলেন। বজলুর রহমান ভূতের গল্প আবার শুরু করলেন। ছেলেমানুষি সব ভূতের গল্প শুনতে ইচ্ছা করে না। মনসুর সাহেব বাধ্য হয়ে শুনছেন।