তুমি এখন যাও হরমুজ। আমার শরীরটা ভালো না। আমি একটু বিশ্রাম করব।
জ্বি আচ্ছা। আরেকটা ছোট্ট আবেদন ছিল স্যার। অপরাধ না নিলে নিবেদন করি–আমি স্যার এই যে ছুটি নিয়ে চলে গেলাম এটা সাহেবকে বলবেন না।
আজিজ কিছু জিজ্ঞেস না করলে অবশ্যই বলব না। তবে জিজ্ঞেস করলে তো বলতেই হবে। আমি মিথ্যা কথা বলি না।
মাঝে মধ্যে দু-একটা মিথ্যা বললে কিছু হয় না স্যার। সত্য যেমন আল্লাহপাকের সৃষ্টি মিথ্যাও তেমন তারই সৃষ্টি।
তুমি এখন যাও হরমুজ।
হরমুজ চলে গেল, তবে যাবার আগে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে মনসুর সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করল।
স্যার, গরিবের জন্যে একটু দোয়া রাখবেন।
আচ্ছা রাখব। দোয়া রাখব। এখন তুমি যাও।
আপনাকে একা ফেলে যেতে খুব পেরেসান, কিন্তু…
তুমি যাও তো।
মনসুর সাহেব সন্ধ্যার আগে নেত্রকোনা শহরের দিকে রওনা হলেন। যে কাজগুলি সারতে হবে সেগুলি হচ্ছে :
১. কাগজ কিনতে হবে।
২. চিনি কিনতে হবে।
৩. লেবু কিনতে হবে।
৪. ডাক্তার বজলুর রহমানকে চোখ দেখাতে হবে।
৫. ফাউনটেনপেনের কালি কিনতে হবে। মোট পাঁচটা কাজ।
পাঁচ সংখ্যাটা ইন্টারেস্টিং। মৌলিক সংখ্যা। প্রাইম নাম্বার। সংখ্যার জগতে চতুর্থ প্রাইম নাম্বার। প্রথমটা হল ১, তারপর ২, তারপর ৩, তারপরই ৫, পাঁচের পর ৭, সাতের পর ১১, এগারোর পর ১৩, তেরোর পর ১৭, সতেরোর পর ১৯…
এক থেকে দশের ভেতর প্রাইম নাম্বার হল পাঁচটা।
দশ থেকে কুড়ির ভেতর চারটা…
কুড়ি থেকে ত্রিশের মধ্যে মাত্র দুটা সংখ্যা বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রাইম নাম্বারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
ত্ৰিশ থেকে চল্লিশের ভেতর…
মনসুর সাহেব মাথা থেকে মৌলিক সংখ্যার চিন্তা-ভাবনা দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। সারাক্ষণ মাথায় এইসব ঘুরলে ভালো লাগে না।
আকাশে মেঘ জমছে। চৈত্রমাসে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করার অর্থ ভালো না। ঝড় হবে। ভোলা মাঠে ঝড়ের ভেতর পড়ার অভিজ্ঞতা ভয়াবহ হবার কথা। মনসুর সাহেবকে তেমন উদ্বিগ্ন দেখা গেল না। অথচ তাঁর মতো আরো যারা শহরের দিকে যাচ্ছে তারা উদ্বিগ্ন। দ্রুত হাঁটছে। বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। সবচে বড় আশঙ্কা হল শিলাবৃষ্টির। চৈত্রের শেষাশেষি আকাশ ঘন কালো হয়ে উঠলে শিলাবৃষ্টির সম্ভাবনা থাকেই। খোলামাঠে শিলাবৃষ্টির হাতে পড়লে ভয়াবহ সমস্যা। আশ্রয় নেবার জায়গা নেই। ইউনিয়ন বোর্ডের এই রাস্তা নতুন হয়েছে। রাস্তার দুপাশে গাছপালা কিছু নেই। বছর দুই আগে বনবিভাগ চারা লাগিয়েছিল। এক সপ্তাহের মধ্যে ছাগলে খেয়ে পরিষ্কার করে ফেলেছে।
ছোটবাজারে আজিজ বেপারির একটা স্টেশনারি দোকান আছে। মনসুর সাহেব সেখান থেকেই কাগজ, কালি কিনলেন। দাম দিতে হল না। তারা খাতায় লিখে রাখে। মাসের শুরুতে বিল করে টাকা নেয়। মনসুর সাহেবের ক্ষীণ সন্দেহ এরা হিসেবে কোনো গণ্ডগোল করে, কারণ তিনি প্রচুর কাগজ কেনেন, কিন্তু বিল এত কম হয়। আজিজ বেপারিকে তিনি তাঁর সন্দেহের কথা বলেছিলেন। আজিজ বলেছে, এইসব নিয়ে আপনি ভাববেন না তো স্যার। আমরা পাইকারি হিসেবে বিল করি। এতে খানিকটা কম হয়।
আজিজ আজ দোকানে ছিল না। তার এক কর্মচারী বদরুল কাগজ এবং কালি পলিথিনের ব্যাগে ভরতে ভরতে বলল, দিনের অবস্থা ভালো না, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যান স্যার। ঝড় হবে। স্যারের সঙ্গে কি ছাতা আছে?
না।
একটা ছাতা নিয়ে যান।
ছাতা নিব না। আমার ছাতা খুব হারায়।
হারালে হারাবে, ছাতাটা নিয়ে যান। আমি বরং একটা রিকশা ঠিক করে দেই। রিকশা আপনাকে নিয়ে যাবে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে রিকশাও পাবেন না-কাঁচা রাস্তায় রিকশা যাবে না।
না না, রিকশা লাগবে না। রিকশায় আমি চড়ি না। রিকশার কঁকুনিতে আমার চিন্তার অসুবিধা হয়।
দোকানি বিস্মিত হয়ে বলল, কি চিন্তা?
মনসুর সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, তেমন কিছু না। হাঁটতে হাঁটতে যা মাথায় আসে। যেমন ধর প্রাইম সংখ্যা…
সেটা কি?
মৌলিক সংখ্যা, যে সংখ্যাকে সেই সংখ্যা এবং ১ এই দুটি ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ভাগ দেয়া যায় না। যেমন ধর তিন একটা মৌলিক সংখ্যা, আবার চার মৌলিক সংখ্যা না। চারকে তুমি দুই দিয়ে ভাগ দিতে পারছ। তারপর আসে পাঁচ। পাঁচ মৌলিক সংখ্যা। পাঁচের পর আসছে সাত…
বদরুল হতচকিত গলায় বলল, আর বলতে হবে না স্যার। মাথা আউলা হয়ে যাচ্ছে। আপনি হাঁটতে হাঁটতে এইসব চিন্তা করেন?
হ্যাঁ। কি হয় এসব চিন্তা করে? কিছু হয় না। মনের আনন্দ।
স্যার, এর মধ্যে আনন্দের কি আছে?
মনসুর সাহেব আনন্দের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারলেন না। ব্যাখ্যা তার নিজেরও জানা নেই। চিন্তা করলে আনন্দ হয়—এটাই শুধু জানেন।
মনসুর সাহেব বললেন, কাগজ কতগুলি দিয়েছ?
তিন দিস্তা দিয়েছি। স্যার, আরো লাগবে?
আরো কিছু দিয়ে দাও। কাগজ এখন বেশি লাগছে।
প্রতি সপ্তাহে কাগজ নেন। আপনি স্যার এত কাগজ দিয়ে করেন কি?
হিসাব-নিকাশ করি।
কীসের হিসাব-নিকাশ?
ইয়ে মানে একটা অঙ্ক করছি। জটিল অঙ্ক…মানে ঠিক…
বদরুল হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সে এই দোকানে কাজ করছে বেশিদিন। নাতিন বছরের মতো হবে। এই তিন বছর ধরেই সে এই মানুষটাকে কাগজ দিয়ে যাচ্ছে। কোনো সপ্তাহে তিন দিস্তা, কোনো সপ্তাহে পাঁচ।
স্যার, অঙ্কটা কি?
তেমন কিছু না। শখের একটা ব্যাপার। যাই কেমন?