হরমুজ মিয়ার উপর কঠিন নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সে প্রায়ই এটা-ওটা বেঁধে ফেলে। সিমের ভর্তা, পাকা টমেটোর ভর্তা, কুমড়ো ফুলের বড়া। মনসুর সাহেব বিরক্ত হন, কিন্তু হরমুজকে কিছু বলতে পারেন না। কারণ তিনি জানেন মানুষ মাত্ৰই বাহুল্যপ্রিয়। একটা বাড়িই মানুষের জন্যে যথেষ্ট, তারপরেও টাকা থাকলেই সে দুটা-তিনটি বাড়ি বানাবে। আজিজ বেপারির নেত্রকোনা শহরেই তিনটা বাড়ি। এখন আবার ঢাকার সোবাহানবাগ এলাকায় বাড়ি বানাচ্ছে। বাড়ি বানানোর খবর দেয়ার জন্যে কে মনসুর সাহেবের কাছে এসেছিল। মনসুর সাহেব বলেছেন—এতগুলি বাড়ির তোমার দরকার কি? একটা মাকড়সাকে দেখ। সে একটাই বাড়ি বানায়। সুতার তৈরি একটাই ঘর। কোনো মাকড়সা দেখবে না যে চার-পাঁচটা ঘর বানিয়ে রেখেছে।
আজিজ খ বিনয়ের সঙ্গে বলেছে, যথার্থ বলেছেন স্যার। যথার্থ কথা। তবে ব্যাপার হল কিবাড়িগুলি ভাড়া দিলে আয় হয়। ফিক্সড ইনকাম। মাসের শেষে হাতে চলে আসে। চিন্তা-ভাবনা করা লাগে না।
এত ইনকাম দিয়ে-ই বা তোমার প্রয়োজন কি?
খরচ-বরচ আছে। টাকার দরকার কখনো শেষ হয় না। তারপর ধরেন, টাকার কারণে দান-খয়রাত করতে পারি। এতে সোয়াব হয়। স্যার শুনলে সুখী হবেন—নিজের খরচে আমি একটা হাফেজিয়া মাদ্রাসা করে দিয়েছি। ভবিষ্যতে
একটা মসজিদ বানানোর ইচ্ছা আছে। মাকড়সার তো আর মাদ্রাসা দিতে হয় না, মসজিদও বানাতে হয় না।
আজিজ বেপারির হাস্যকর যুক্তিতে রাগে গা জ্বলে যাবার কথা। মনসুর সাহেবের তেমন রাগ হয় না। নির্বোধ মানুষের সকল কথা ধরতে নেই। নির্বোধ মানুষের যুক্তিও শুনতে নেই। আজিজকে তিনি নির্বোধ শ্রেণীর একজন হিসেবেই জানেন। নির্বোধদের প্রতি এক ধরনের মমতা মানুষের থাকে। তারও আছে। আজিজ খাঁ ঘোর বৈষয়িক মানুষ। বৈষয়িক মানুষ বিষয় ছাড়া অন্য কিছু ভালবাসতে পারে না। তাদের সেই ক্ষমতা থাকে না। কিন্তু আজিজ খাঁ সত্যিকার অর্থেই মনসুর সাহেবকে ভালবাসেন। নতুন ফ্যান কিনে এনে লাগিয়ে দেয়ার পেছনে তাঁর ভালোবাসাই কাজ করেছে। অন্য কিছু না। তাঁর গুদামঘর পর্যন্ত ইলেকট্রিসিটির লাইন আনার জন্যে তিনি সাবডিভিশনাল ইনজিনিয়ারকে এক হাজার টাকা ঘুস দিয়েছেন।
মনসুর সাহেবকে যেন পোলাওয়ের চালের ভাত রান্না করে দেয়া হয় সে জন্যে মাসের শুরুতেই তিনি আধমণ চিনিগুড়া চাল হরমুজের কাছে পাঠিয়ে দেন। হরমুজকে বলা হয়েছে এই ব্যাপারটা সে যেন গোপন রাখে। হরমুজ সেই পোলাওয়ের চাল বাজারে বিক্রি করে দেয়। কারণ সে লক্ষ করেছে মনসুর সাহেব পোলাওয়ের চাল এবং সাধারণ চালের পার্থক্য ধরতে পারেন না। কয়েকবার সে পোলাওয়ের চালের ভাত বেঁধে দিয়েছে। মনসুর সাহেব একটা শব্দও করেননি।
আজিজ বেপারির এই বাড়িতে মনসুর সাহেব আছেন গত এগারো বছর ধরে। প্রতি মাসে ঘরে থাকার ভাড়া বাবত ত্ৰিশটা টাকা নিজে আজিজ বেপারিকে দিয়ে তার কাছ থেকে রসিদ নিয়ে আসেন। তিনি জানেন না এগারো বছর আগে ত্রিশ টাকার যে মূল্য ছিল আজ সে মূল্য নেই। এক কেজি চিনির দামই ত্ৰিশ টাকা। জগৎ-সংসার থেমে নেই—শুধু মনসুর সাহেব থেমে আছেন। তিনি তা জানেন না।
চোখের সমস্যা নিয়ে মনসুর সাহেব অসময়ে তাঁর ঘরে ফিরে এলেন। তালা খুলে বিছানায় শুয়ে রইলেন। দুপুরে তাঁর ঘুমানোর অভ্যাস নেই। আজ বিকেল। পর্যন্ত ঘুমুলেন। ঘুম ভেঙে মুখ ধুতে গিয়ে লক্ষ করলেন—চোখ জ্বালা করছে। তার ভুরু কুঞ্চিত হল। চোখ জ্বালা করলে তো সমস্যা। রাত জেগে কাজ করতে হবে। চোখ জ্বালা করলে কাজ করবেন কীভাবে? ডাক্তারের কাছ থেকে ঘুরে আসাই ভালো। তা ছাড়া ঘরে কাগজ নেই। কাগজ কিনতে হবে। কলমের কালি কিনতে হবে। বল পয়েন্টে তিনি লিখতে পারেন না। আরো কিছু টুকটাক জিনিস বোধহয় লাগবে। চিনি নেই। লেবু নেই। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আগে এক গ্লাস লেবুর সরবত খান। এটাও এক অর্থে বাহুল্য। তবে অভ্যাস হয়ে গেছে। অভ্যাস খুব খারাপ জিনিস। অভ্যাস মানুষকে বিলাসী করে।
স্যার কি ন্দ্রিা করতেছেন?
হরমুজ মিয়া দরজা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। কঠিন কঠিন বাক্য ব্যবহার করে সে আনন্দ পায়।
কি ব্যাপার হরমুজ?
আপনের কাছে একটা আবেদন ছিল। বল।
হরমুজ ঘরে ঢুকল। দীর্ঘ কোনো গল্পের প্রস্তুতি সে নিচ্ছে। এক দুই কথায় সে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না।
স্যার, আমার মধ্যম কন্যার শাদি হয়েছে—সান্দিকোনায়। জামাই ঘরামির কাজ করে। চৈত্র মাসে এরার কোনো কাজকাম থাকে না…
মনসুর সাহেব হরমুজের গল্প সংক্ষেপ করার জন্যে বললেন সাহায্য চাও?
জ্বি না। সাহায্য না।
তাহলে কি?
মেয়েটার সন্তান হবে। এর আগে একবার গর্ভ নষ্ট হয়েছে। আমাকে বলেছে মদনপুরের পীর সাহেবের ফুল গাছ থেকে একটা পুষ্প তার জন্যে নিয়ে যেতে…
ছুটি চাও?
জ্বি। দুই দিনের ছুটি।
যাও।
আপনার খাওয়া-দাওয়া?
আমার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। একজন তো আছেই–। বসির আছে না?
জ্বি না। বসির ছুটি নিয়ে চলে গেছে।
অসুবিধে কিছু নেই।
বাইরে-টাইরে ভ্রমণের জন্যে গেলে গেইটে তালা দিয়ে যাবেন। এই যে স্যার তালাচাবি।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
ভয় পাবেন না তো স্যার?
না, ভয় পাব কেন? ভয় পাবার কিছু আছে?
জ্বি না। ভয়ের কিছু নাই। তবে স্যার সত্য কথা বলতে কি জিনের সামান্য উদ্রব আছে। একটা দুষ্ট জিন আছে—গ্রামেই থাকে। মাঝে মধ্যে ফাইলামি করে। একবার কি হয়েছে স্যার শুনুন-শ্ৰবণ মাস—বুম বৃষ্টি…