মনসুর সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। হেডমাস্টার সাহেব বললেন, বাসায় কি নিজে নিজে যেতে পারবেন, না কেউ গিয়ে দিয়ে আসবে?
যেতে পারব। নিজেই যেতে পারব।
বজলুর ফার্মেসিতে আগে যাবেন। বজলু আছে। ওকে চোখটা দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে তারপর যাবেন।
জ্বি আচ্ছা।
আপনার বয়স হয়েছে। শরীর দুর্বল। এই বয়সে শরীরের দিকে খুব যত্ন নিতে হয়।
মনসুর সাহেব খুবই লজ্জিত বোধ করছেন। ঘুমিয়ে পড়েছেন সেই কারণে লজ্জা। তারচেয়েও বড় লজ্জা তাঁর কারণে হেডমাস্টার সাহেব কথা বলে সময় নষ্ট করছেন। ছাত্রদের না পড়িয়ে–অকারণ উদ্বেগ দেখাচ্ছেন অন্যের স্বাস্থ্য নিয়ে। অন্যায়। ঘোরতর অন্যায়। তিনি চেয়ার থেকে নামলেন, নামতে গিয়ে মনে হল, পায়েও তেমন জোর পাচ্ছেন না। পড়ে যাচ্ছিলেন। হেডমাস্টার সাহেব হাত ধরে ফেলে আবারও বললেন, আমি আপনার উপর খুবই রাগ করেছি মনসুর সাহেব। এক্সট্রিমলি এনয়েড। আগে শরীর, তারপর অন্য কথা। শরীর গেল তো সবই গেল। সংস্কৃতিতে এ বিষয়ে একটা শ্লোক আছে। শ্লোকটা হচ্ছে…। যাই হোক, মনে পড়ছে না। শরীরং…
মনসুর সাহেব দীৰ্ঘ নিশ্বাস ফেললেন—অকারণে একটা মানুষ এত কথা বলে কেন? একই কথা বারবার বলার অর্থ কি? তিনি ক্লাস থেকে বেরুবার সময়ও ধরজায় ধাক্কা খেলেন। ছাত্ররা অবাক হয়ে তাঁকে দেখছে।
হেডমাস্টার সাহেব গ্রামার পড়াবেন। চক হাতে ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে গিয়ে তাঁকে থমকে দাঁড়াতে হল। ব্ল্যাকবোর্ড বিচিত্র সব জিনিস লেখা। সাঙ্কেতিক চিহ্নের মতো চিহ্ন বোর্ডের এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত ঠাসা।
হেডমাস্টার সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন, এইসব কি? কে লিখেছে এসব? হু হাজ রিটেন দিজ?
ক্লাস ক্যাপ্টেন উঠে দাঁড়াল।
জবাব দিচ্ছ না কেন? কে এইসব হিবিজিবি লিখেছে? হু ইজ দ্য কালপ্রিট?
মনসুর স্যার।
মনসুর সাহেব লিখেছেন।
জ্বি। কি
এইসব?
জানি না স্যার।
জান না মানে? তোমরা জিজ্ঞেস করনি?
জ্বি না।
তোমাদের জানার আগ্রহ ছিল না?
ভয় লাগে স্যার।
উনার কী পড়াবার কথা ছিল?
এলজেব্র্যা।
হেডমাস্টার সাহেব ডাস্টার হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। বোর্ডের লেখাগুলি মুছে ফেলা উচিত কি-না তিনি বুঝতে পারছেন না। কাউকে কি ডেকে এনে দেখাবেন? মানুষটার হয়েছে কি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এ তো বড় চিন্তার বিষয় হল। মানুষটাকে একা একা বিদেয় করা ঠিক হয়নি। একজন কাউকে সঙ্গে দেয়া উচিত ছিল।
মনসুর সাহেব ক্লাস থেকে বের হয়ে কমনরুমে খানিকক্ষণ বসলেন। ছুটির দরখাস্ত লিখে রেখে যাওয়া দরকার। হেডমাস্টার সাহেব ছুটি দিয়েছেন বলেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি রওনা হবেন এটা ঠিক না।
কমনরুমে ফজলুর রহমান বসে আছেন। খবরের কাগজ পড়ছেন। ক্লাসের ঘণ্টা পড়ে গেছে, তারপরেও উনি বসে আছেন কেন? এই মানুষটা সব সময় ক্লাসে যেতে দেরি করেন। অনুচিত একটা কাজ। তার থেকে ছাত্ররা ফাঁকি শিখবে। এই বয়সটা হল তাদের শেখার বয়স। এই বয়সে তারা যা দেখে তাই শেখে।
ফজলুর রহমান সাহেব!
জ্বি!
ক্লাস নেই?
আছে।
যাবেন না?
খবরের কাগজটায় একটু চোখ বুলিয়ে যাই। বাংলা ফার্স্ট পেপার। এটা পড়ানো না পড়ানো একই।
বাংলার কথা শুনে মনসুর সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন ভালো কথা, আপনি কি ঈশপের ঐ গল্পটা জানেন?
কোন্ গল্প?
ঐ যে একটা শেয়াল ধোপার নীলের গামলায় পড়ে গেল। তার গা হয়ে গেল নীল…
শেয়াল না। একটা গাধা পড়েছিল।
ঐ গল্পের মোরালটা কি?
ফজলুর রহমান সাহেব খবরের কাগজ মুড়ে রাখতে রাখতে বললেন, ঈশপের গল্পের মোরাল সবই ফালতু মোরাল। এইসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো কারণ নেই—এই যুগের মোরাল হল—Eat, drink and be happy.
মনসুর সাহেব ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেললেন। ছুটির দরখাস্ত লিখতে তার কষ্ট হচ্ছে। চোখ দিয়ে খুব পানি পড়ছে।
মনসুর সাহেব
মনসুর সাহেব থাকেন আজিজ খাঁ বেপারির গুদামঘরের উপরে। কেরোগেটেড টিনের দেয়ালে ঘেরা গুদামঘর। তার উপরে দুটা ঘর। একটায় থাকেন মনসুর সাহেব। অন্য ঘরটা খালি। আজিজ খাঁ বলেছেন—স্যার, ইচ্ছা করলে এই ঘরটাও আপনি ব্যবহার করতে পারেন। একটায় ঘুমাবেন, অন্যটায় লেখাপড়ার কাজ করবেন।
মনসুর সাহেব রাজি হননি। তাঁর জন্যে একটা কামরাই যথেষ্ট। দুটা কামরা মানেই বাহুল্য। তিনি সারাজীবন বাহুল্য বর্জন করতে চেয়েছেন।
নিজের ঘরটা তিনি তার প্রয়োজনমতো সাজিয়ে নিয়েছেন। বড় একটা খাট আছে। ছোট খাটে তিনি শুতে পারেন না। ঘুমুবার সময় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমুতে ভালো লাগে। খাটের সঙ্গেই টেবিল। টেবিলটাও বড়। ঘরে কোনো চেয়ার নেই। খাটে বসেই যেহেতু টেবিলে লেখালেখি করা যায় কাজেই চেয়ার তাঁর কাছে বাহুল্য বলে মনে হয়েছে। একটা আলনা আছে। আলনা তাঁর কাছে প্রয়োজনীয়। কাপড়-চোপড় সামনে থাকে। যখন যেটা দরকার হাত বাড়িয়ে নিতে পারেন।।
তাঁর ঘরে শৌখিন জিনিসের মধ্যে একটা সিলিং ফ্যান আছে। নতুন সিলিং ফ্যান। এর পাখা খবরের কাগজ দিয়ে মোড়া। আজিজ খা বেপারি সিলিং ফ্যান। লাগিয়ে দিয়েছেন। ইলেকট্রিসিটি নেই বলে সিলিং ফ্যান কখনো চলে না।
নেত্রকোনা শহরে ইলেকট্রিসিটি আছে। আজিজ বেপারির গুদাম শহরের বাইরে বলে ইলেকট্রিসিটির লাইন এখনো দেয়নি। তবে পোল বসাচ্ছে। খুব শিগগিরই ইলেকট্রিসিটি চলে আসার কথা।
মনসুর সাহেবের জায়গাটা খুব পছন্দ। নিরিবিলির কারণেই পছন্দ। গুদামে যখন মাল তোলা হয় কিংবা মাল খালাস করা হয় তখন কিছু চৈ-চৈ থাকে। বাকি সময়টা সুনসান নীরবতা। গুদামের দুজন দারোয়ান। এর একজন কোনো কথাই বলে না। অন্যজনের কথা বলার প্রচণ্ড নেশা। কথা বলার লোক পায় না। বলে সেও কথা বলতে পারে না। এই দারোয়ানের নাম হরমুজ মিয়া। সে মনসুর সাহেবের খাওয়া-দাওয়া দেখে। এই কাজের জন্যে মাসে তাকে পঞ্চাশ টাকা করে দেয়া হয়। মনসুর সাহেবের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা অত্যন্ত সরল। তিনি বলে দিয়েছেন, এক পদের বেশি দ্বিতীয়পদ যেন কখনো রান্না করা না হয়। দ্বিতীয়পদ মানেই বাহুল্য।