আপনার দাদাজানকে এঁদের সঙ্গে তুলনা করাটা কি ঠিক হচ্ছে?
হ্যাঁ ঠিক হচ্ছে। তিনি মহান গণিতজ্ঞ ছিলেন তার প্রতিভা বাইরের কেউ জানতে পারেনি।
ফিবোনাক্কি হাসছে। শব্দ করে হাসছে। মনসুর সাহেব বললেন, হাস কেন?
হাসছি কারণ গণিতজ্ঞরা দুর্ভাগা। বেশির ভাগ গণিতজ্ঞের প্রতিভা অজ্ঞাত থেকে গেছে। সেই তুলনায় নিম্নমানের প্রতিভা অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
যেমন?
যেমন ধরুন গানের প্রতিভা। একজনের সুন্দর গানের গলা—তার প্রতিভা কখনোই চাপা থাকবে নাসে গান গাইবে। কেউ তা শুনবে। তারা অন্যদের জানাবে প্রতিভার খবর ছড়াবে জিওমেট্রিক্যাল প্রসেনের নিয়মে কিন্তু আপনাদের বেলায় ব্যাপারটা ভিন্ন। আপনারা কাজ করবেন সেই কাজ ফাইলবন্দি পড়ে থাকবে। এক সময় ফাইল যাবে হারিয়ে।
তুমি আমাকে বিরক্ত করছ ফিবোনাক্কি। তোমার জন্যে আমি কাজ করতে পারছি না।
আর বিরক্ত করব না কাজ করুন। আপনার মাথার যন্ত্রণার অবস্থা কি? এখনো যন্ত্রণা হচ্ছে?
হ্যাঁ।
খুব বেশি?
হ্যাঁ।
হরমুজকে বলুন যন্ত্রণার কোনো ওষুধ নিয়ে আসতে।
তুমি আমাকে খুব বিরক্ত করছ।
আপনার কষ্ট দেখে খারাপ লাগছে বলেই করছি। আর করব না।
মনসুর সাহেব লিখে যাচ্ছেন। তাঁর চোখ আবার সমস্যা করছে—পানি পড়ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে যাওয়ায় দেখতে অসুবিধা হচ্ছে। মাথার যন্ত্রণা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কিছুক্ষণ ঘুমুতে পারলে ভালো হত। একবার ঘুমুতে গেলে সেই ঘুম আর ভাঙবে না। ঝুম ঝুম শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টি হচ্ছে না-কি?
ফিবোনাক্কি।
জ্বি স্যার।
বৃষ্টি হচ্ছে না-কি।
হচ্ছে স্যার। এই জন্যেইতো নৌকা বানিয়ে এত আরাম পাচ্ছি।
ফিবোনাক্কি নৌকা বানাচ্ছে। একটা দুটা না অসংখ্য। দ্রুত বানিয়ে যাচ্ছে। সে ঘর ভর্তি করে ফেলছে কাগজের নৌকায়।
ফিবোনাক্কি গুন গুন করে গাইছে
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান।
একই লাইন বার বার, বার বার। গান শুনতে শুনতেই মনসুর সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন।
হরমুজ হেডমাস্টার সাহেবকে খবর দিয়ে নিয়ে এসেছে। হেডমাস্টার সাহেব সত্যি সত্যি স্কুল ছুটি দিয়ে এসেছেন। এসেছেন আজিজ খা, বদরুল।
মনসুর সাহেব চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। মুখের কষ বেয়ে রক্তের ক্ষীণ ধারা। বুক ওঠা নামা করছে। প্রাণ এখনো আছে। কতক্ষণ থাকবে সেটাই কথা।
ঘরময় কাগজ ছড়ানো—লেখা কাগজ, ভেঁড়া কাগজ, আর অসংখ্য কাগজের নৌকা।
আজিজ খাঁ বললেন, এসব কি? কাগজের নৌকা।
বদরুল বলল, স্যারের মাথায় গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল—আমার কাছ থেকে কাগজ নিতেন—নৌকা বানিয়ে নদীতে ছাড়তেন।
আজিজ খাঁ হুংকার দিয়ে বললেন, আগে বলনি কেন? কেন আগে বলনি?
বদরুল কাঁদছে। তার চোখ দিয়ে টপ টপ পানি পড়ছে। হরমুজ কাদোকাদো গলায় বলল, এই কাগজগুলাই স্যারের সর্বনাশ করেছে। স্যার দিন রাত লেখতেন-লেখতে লেখতে…
হেডমাস্টার সাহেব ক্ষিপ্ত গলায় বললেন—সব কাগজ নিয়ে আগুন দিয়ে। পুড়িয়ে ফেল। সব কাগজ। একটাও যেন না থাকে। হারামজাদা কাগজ।
অচেতন অবস্থাতেও মনসুর সাহেব কথা বলার চেষ্টা করলেননা না। বলতে পারলেন না—শুধু তাঁর ঠোট কাপল।
হেডমাস্টার সাহেব বললেন—এক্ষুণি উনাকে ঢাকায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা। করতে হবে। এক সেকেন্ডও দেরি করা যাবে না—আশ্চর্য কেউ একজন বললও না লোকটার এই অবস্থা? আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে… বলতে বলতে হেডমাস্টার সাহেবের চোখে পানি এসে গেল।
আজিজ খা গাড়ি নিয়ে এসেছেন। গাড়ি সরাসরি ঢাকা যাবে। হরমুজ সব কাগজ আগুনে দিয়েছে। আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে
হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে কিছুক্ষণের জন্যে মনসুর সাহেবের জ্ঞান ফিরল। অপরিচিত ঠাণ্ডা ঘর। শরীরে নানা যন্ত্রপাতি লাগানো। অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। কয়েকজন ডাক্তার এবং নার্স উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছেন। মনসুর সাহেব ব্যস্ত হয়ে খুঁজলেন ফিবোনাক্কিকে। ঐ তো ফিবোনাক্কি। তার সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু ঠোট ফাঁক করার ক্ষমতা তার নেই কথাতো অনেক দূরের ব্যাপার। তিনি মনে মনে ডাকলেন—ফিবোনাক্কি।
ফিবোনাক্কি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, জি স্যার।
ওরা আমার সমস্ত কাগজপত্র আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে।
স্যার আমি জানি।
তুমি কি খুশি হয়েছ ফিবোনাক্কি?
ফিবোনাক্কি জবাব দিল না। মনসুর সাহেব বললেন–আমি তোমাকে আমার কল্পনার একটি অংশ ভেবে ভুল করেছিলাম। তুমি আমার কল্পনার অংশ নও। তুমি আসলেই শূন্য জগতের কেউ।
স্যার আপনি ঠিকই ধরেছেন।
তোমাকে পাঠানো হয়েছিল আমার কাজ নষ্ট করে দেয়ার জন্যে।
জ্বি স্যার।
যখন বুঝতে পারলাম তখন আর করার কিছু নেই। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাচ্ছি তাই না ফিবোনাক্কি।
স্যার আমার তাই ধারণা।
মৃত্যু কেমন ফিবোনাক্কি?
মৃত্যু কেমন আমি বলতে পারছি না স্যার। আমাদের জগতে মৃত্যু নেই। আমরা বাস করি মৃত্যুহীন জগতে।
ও।
আমরা যদি আমাদের জগতটাকে সুরক্ষিত রাখতে চাই সেটা কি অন্যায়?
না অন্যায় নয়।
পৃথিবীর মানুষরা আমাদের জগতে ঢুকে পড়তে চাচ্ছে। তারা শূন্যের রহস্য একবার ধরে ফেললে আমাদের কি হবে? আমরা থাকতে চাই আমাদের মতো। সেখানে কারোরই প্রবেশাধিকার নেই। আমরা কিছুতেই এ রহস্য ভেদ করতে দেব না। যারাই এই চেষ্টা করবে তাদেরই আমরা দূরে সরিয়ে দেব। তাদের কাজ নষ্ট করে দেব।