…আমার শরীর খুবই অসুস্থ। স্কুলের দায়িত্ব পালনে বর্তমানে অক্ষম। আমার অতি জরুরি কিছু ব্যক্তিগত কাজও শেষ করা প্রয়োজন। কাজেই আমি আর স্কুলে আসব না বলে স্থির করেছি। অবসর গ্রহণের আগেই আমি অবসর প্রার্থনা করছি।…
হেডমাস্টার সাহেব স্কুলে ছিলেন না। ফুড ফর ওয়ার্ক প্রগ্রামে সরকার গম দিচ্ছে তিনি সেই গমের ব্যাপারে সিও সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে গেছেন। কখন ফিরবেন ঠিক নেই। মনসুর সাহেব হেডস্যারের টেবিলে দরখাস্ত রেখে বাসার দিকে রওনা হলেন। তাঁর গায়ের তাপ আরো বেড়েছে, তিনি ঠিকমতো পা ফেলতেও পারছেন না। তাঁর মনে হল প্রকৃতির একটা নিষ্ঠুর দিক আছে। এই নিষ্ঠুরতা তিনি মানুষের ক্ষেত্রেই সবচে বেশি প্রয়োগ করেন। বয়সের সঙ্গে মানুষের জ্ঞান বাড়ে, বুদ্ধি বাড়ে, বিচক্ষণতা বাড়ে, যুক্তি বাড়ে কিন্তু এই সবের সমন্বয় করে কাজ করার যে ক্ষমতা তা কমতে থাকে। পরিপূর্ণ মাত্রায় সব দেয়ার শেষে হঠাৎ একদিন তিনি একসঙ্গে সব কেড়ে নেন।
হরমুজ বলল, স্যার আপনের কি হইছে?
শরীর ভালো না জ্বর আসছে। আর কিছু না। দুপুরে আমি কিছু খাব না। উপাষ দিব।
ডাক্তার আনি।
না ডাক্তার লাগবে না। তুমি ব্যস্ত হয়ো না।
আপনার শরীরের এই অবস্থা আমি ব্যস্ত হব না। এটা স্যার কি বলেন।
তুমি ভালো করে আমাকে লেবুর সরবত দাও। আর কিছু লাগবে না।
লেবুর সরবত বানিয়ে এনে হরমুজ মনসুর সাহেবের গায়ে হাত রেখে প্রায় কেঁদে ফেলল। জ্বরে সর্বাঙ্গ পুড়ে যাচ্ছে। সে ভীত গলায় বলল, এত জটিল অবস্থা।
মনসুর সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, অবস্থা মোটেই জটিল না। অবস্থা সহজ। তুমি এখন আমার সামনে থেকে যাও আমি কাজ করব।
এই শরীরে কি কাজ করবেন।
কাজ শুরু করলে শরীরের কথা মনে থাকবে না।
আপনার পায়ে ধরি স্যার আপনি বিশ্রাম করেন।
হরমুজ সত্যি সত্যি পা ধরতে এগিয়ে এল। মনসুর সাহেব ধমক দিয়ে তাকে বিয়ে করে সত্যি সত্যি কাগজ কলম নিয়ে বসলেন। পুরানো সব ফাইল বের করলেন। সব হাতের কাছে থাকুক। একটা ভালো ক্যালকুলেটর থাকলে খুব উপকার হত। হিসেবগুলি দ্রুত করা যেত। আজিজ বেপারিকে বললে সে এনে দেবে। এই লোক তাকে পছন্দ করে। খুবই পছন্দ করে। এই জীবনে তিনি তেমন কিছু পান নি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। হরমুজের কথা ধরা যাক। তাকে অসুস্থ দেখে সে প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। হেডমাস্টার সাহেবের কথাই ধরা যাক। তিনি অসুস্থ শুনলে দ্রলোক স্কুল ছুটি দিয়ে সব ছাত্র নিয়ে চলে আসবেন। ডাক্তার বজলুর রহমান…এমনকি বদরুল…
মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। তীব্র যন্ত্রণা। একটু আগে লেবুর সরবত খেয়েছেন এখন আবার পিপাসা বোধ করছেন। শরীরও কাঁপছে। ঘরে থার্মোমিটার থাকলেও জ্বর মাপা যেত। ঘরে কোনো থার্মোমিটার নেই।
মনসুর সাহেব উবু হয়ে বসেছেন—বসার ভঙ্গির জন্যেই কি লিখতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি বুকের নিচে বালিশ দিয়ে শুয়ে পড়লেন। বুকে হাঁপ ধরছে। ধরুক। ঘরে আলো কমে আসছে। আকাশে কি মেঘ আছে। চৈত্র মাসে এসব কি শুরু হল দুদিন পর পর বৃষ্টি—মনসুর সাহেব অঙ্কের পাশাপাশি লিখলেন–
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
নদেয় এল বান।
স্যার কেমন আছেন?
মনসুর সাহেব মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন–ফিবোনাক্কি। দিনের বেলা এই প্রথম তাঁর দেখা পাওয়া। বাহ সুন্দর চেহারাতে। এত সুন্দর চোখ। যে কোনো সুন্দর জিনিস দেখামাত্র হাত দিয়ে ছুঁতে ইচ্ছা করে, শুরু চোখ ঠুতে ইচ্ছে করে না। ফিবোনাক্কি আবার বলল, কেমন আছেন স্যার?
ভালো।
কাজতো অনেকদূর করেছেন।
চেষ্টা করছি।
ঐ দুটা লাইন কি স্যার কবিতা?
হুঁ।
হঠাৎ কবিতা লিখলেন যে?
বুঝতে পারছি না।
আমার মনে হয় আপনার এখন বিশ্রাম করা উচিত। শুয়ে থাকুন।
শুয়েই তো আছি।
চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন।
অল্প কিছু বাকি আছে ঐটা শেষ হলেই…
মনসুর সাহেব কাগজের উপর ঝুঁকে পড়লেন। ফিবোনাক্কি বলল আমাকে কিছু কাগজ দেবেন স্যার।
কি করবে?
নৌকা বানাব। কাগজের নৌকা। ঐদিন নৌকা বানিয়ে খুব আরাম পেয়েছি। আপনি কি স্যার মগরা নদীতে আমার ভাসানো কাগজের নৌকা দেখেছেন?
না।
সবগুলি নৌকা যখন চলছিল দেখতে খুব মজা লাগছিল।
তোমার কথায় আমার কাজের অসুবিধা হচ্ছে।
তাহলে স্যার আর কথা বলব না। আমি যদি নিঃশব্দে নৌকা বানিয়ে যাই তাহলে কি কাজের অসুবিধা হবে?
না।
স্যার ঘরে কি মোম আছে।
কেন?
নৌকা পানিতে ভাসালে সমস্যা যা হয় তা হল কাগজ ভিজে যায়। কাগজ ভিজে নৌকা পানিতে তলিয়ে যায়। আমি ভাবছি মোম গলিয়ে নৌকার পেছনে লাগিয়ে দেব। তাহলে নৌকা আর ডুববে না।
ঘরে মোম নেই।
হরমুজকে দিয়ে আনানো যায় না?
ফিবোনাক্কি তুমি আমাকে বিরক্ত করছ।
নৌকার নিচটায় মোমতো মাখিয়ে দিলে নৌকা ভারি হবে বাতাসে সহজে দুলবে না।
তুমি অকারণ কথা বলছ ফিবোনাক্কি—আমার চিন্তায় অসুবিধা হচ্ছে।
আমি খুব দুঃখিত—স্যার পাই সংখ্যাটির রহস্যময়তা সম্পর্কে আপনার কি ধারণা? পাই হল বৃত্তের পরিধি এবং ব্যাসের অনুপাত। আপাত দৃষ্টিতে কত সহজ একটা ব্যাপার। আপনার রাশিমালায় এই পাই নিয়ে আসা যায় না…
তুমি আমাকে আমার মতো কাজ করতে দাও।
আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।
আমার কারোর সাহায্যের প্রয়োজন নেই।
স্যার খুব ভুল কথা বলছেন—একা একা আগানো যায় না। আগাতে হলে সাহায্য লাগে…
সবার লাগে না। গণিতজ্ঞ এবেলিয়ানের লাগেনি, রামানুজনের লাগেনি, আমার দাদাজানের লাগেনি…