শুয়ে পড়তে বলছ?
হ্যাঁ।
একটা কথা ফিবোনাক্কি, শূন্য জগতে মানুষের আয়ু কি? মানুষ সে জগতে কতদিন বাঁচে?
সেই জগতে মানুষের আয়ু একই সঙ্গে শূন্য এই সঙ্গে অসীম?
বুঝতে পারছি না।
সেটা হচ্ছে অস্তিত্ব এবং অস্তিত্বহীনতার জগত।
বুঝতে পারছি না।
স্যার আপনি বিশ্রাম করুন। ঘুমুতে যান।
আমার ঘুমুতে ভয় লাগছে।
কেন?
হঠাৎ হয়তো ঘুম ভেঙে আমার দাদাজানের মতো…
উনার সমস্যা আপনার হবে না।
কেন?
উনার পাশে সেই দুঃসময়ে কেউ ছিল না। আপনার পাশে আমি আছি।
তুমি কি সত্যি সত্যি আমার কল্পনা, নাকি তুমি শূন্যের জগত থেকে উড়ে এসেছ?
আমি আপনার কল্পনা কিন্তু আমার বাস শূন্য জগতে।
কিছুই বুঝতে পারছি না।
বুঝতে পারবেন। খুব শিগগিরই বুঝতে পারবেন। আপনার কাজ শেষ করুন।
কাগজ তো নেই। কীভাবে কাজ করব?
মনসুর সাহেব ঘরে ফিরে এলেন। হারিকেন নিভিয়ে বিছানায় গেলেন। ভয়াবহ ক্লান্তি তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। আকাশে মরা চাদ, সেই আলো এসে পড়েছে তাঁর বিছানার এক অংশে।
শূন্য জগতে কি চন্দ্ৰলোক আছে? সেই জগতে কি জোছনার ফুল ফুটে। পাখি গান গায়?
Everything was once created from nothing.
শূন্য থেকে সব সৃষ্টি হয়েছে। শূন্যতেই সব ফিরে যাবে।
মনসুর সাহেবের মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। ভোতা যন্ত্ৰণা। মানুষের প্রধান অংশ কি?
মানুষের প্রধান অংশ তার চেতনা। এই চেতনাকে ধারণ করছে শরীর। শরীরকে বাদ দিয়ে চেতনার যে অস্তিত্ব সেই অস্তিত্বের জগতই কি শূন্যের জগত, না-কি এর বাইরেও কিছু।
খাটের নিচে ইদুর খচখচ করছে। এই অতি ক্ষুদ্র প্রাণীর চেতনা কি আদি চেতনারই অংশ? বিরাট এক রাশিমালা? যে রাশিমালার যোগফল শূন্য।
শরীরে এত ক্লান্তি অথচ ঘুম আসছে না। ঘুম আনতে হলে কি করতে হয় মেষ গুণতে হয়।
মনসুর সাহেব মেষের বিশাল পাল কল্পনা করতে লাগলেন। একটি মেষ আসছে। আবার একটি। এখন একটির সঙ্গে আসছে দুটি। এইবার তিনটি…মেষ পাল আসছে ফিবোনাক্কি রাশিমালায়–
১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩…
আচ্ছা এখন এই মেষের পালে কয়েকটা নেকড়ে ঢুকিয়ে দেয়া যাক। নেকড়েগুলি মেষ খেতে শুরু করবে। ব্যাপারটা এমনভাবে ঘটবে যে মেষ এবং নেকড়ের সংখ্যা শুরুতে সমান থাকলেও সময়ের সঙ্গে কমতে শুরু করবে। নেকড়ে যেমন মেঘ মারবে তেমনি মেষরা নেকড়ে মারবে…কাজেই নেকড়ের জন্যে একটি রাশিমালা প্রয়োজন…
মনসুর সাহেব উঠে বসলেন পাওয়া যাচ্ছে। কিছু একটা পাওয়া যাচ্ছে। কাগজ ঘরে নেই। কাগজের খুব প্রয়োজন ছিল।
ধন্যবাদ ফিবোনাক্কি
বদরুল চোখ বড় বড় করে বলল, আবার কাগজ?
মনসুর সাহেব বললেন, হ্যাঁ।
মনসুর সাহেবের চোখ লাল। চুল উস্কুখুম্বু। গায়ে জ্বর আছে। আজ তিনি ক্লাসেও যাননি।
কাগজ কতগুলো দেব? পাঁচ দিস্তা?
না। দশ দিস্তা।
গতকালই তো স্যার পাঁচ দিস্তা কাগজ নিয়ে গেছেন। শেষ হয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
এক রাতে অঙ্ক করে ভরিয়ে ফেলেছেন?
না। অন্য কাজে…
বদরুল কৌতূহল চাপতে পারল না। আগ্রহ নিয়ে বলল, পাঁচ দিস্তা কাগজ দিয়ে কি করেছেন?
নৌকা বানালাম। নৌকা বানালেন?
কাগজের নৌকা?
হুঁ।
সেই নৌকা দিয়ে কি করলেন স্যার?
মনসুর সাহেব অস্বস্তির সঙ্গে বললেন—নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছি।
বদরুলের মুখ হা হয়ে গেল। সে গলার বিস্ময় চাপা দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে বলল—মগরা নদীতে সব কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছেন?
হুঁ।
খুব ভালো করেছেন। পুলাপানরা কাগজের নৌকা ভাসাবে, আমরা ভাসাব না তা হয় না। বসেন স্যার চা খান।
না চা খাব না। শরীর ভালো না।
চা না খেলেও একটু বসুন। আপনার মতো জ্ঞানী লোকের পাশে কিছুক্ষণ থাকলেও গায়ে জ্ঞানের বাতাস লাগবে। প্লিজ স্যার চেয়ারটায় বসুন।
মনসুর সাহেব কথা বাড়ালেন না। বসলেন।
আপনি হলেন স্যার জ্ঞান-সমুদ্র। ছোটখাটো জ্ঞানী প্রায়ই দেখা যায় জ্ঞান-চৌবাচ্চা, জ্ঞান-ডোবা, জ্ঞান-পুকুর। কিন্তু জ্ঞান-সমুদ্র কখনো দেখা যায়। না। আপনি যে এসে বসে থাকেন এত ভালো লাগে।
মনসুর সাহেব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ছেলেটা ভালো রসিকতা করছে। সে সবার সঙ্গেই রসিকতা করে না শুধু তার সঙ্গেই করছে।
বদরুল চোখ বড় বড় করে বলল, আমি স্যার একটা কাজ করব। আপনার কিছু পায়ের ধুলা ডেনোর একটা টিনে ভয়ে রাখব। জীবনের একটা সঞ্চয় হয়ে থাকবে। লোকজনদের বলতে পারব হায়াৎ মউতের কথাতো বলা যায় না। হঠাৎ একদিন মরে গেলেন তখন ধুলা পাব কোথায়?
আমি আজ উঠি বদরুল?
জ্বি আচ্ছা।
মনসুর সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন–রসিকতা আমি করতে পারি না। সবাই সব জিনিস পারে না। রসিকতা করার বিদ্যা আমার অনায়ত্ত। তুমি করতে পার। তোমার রসিকতা শুনতে ভালো লাগে। তোমার রসিকতা শোনার ললাভেই মাঝে মাঝে এখানে এসে বসে থাকি।
বদরুল হা করে তাকিয়ে রইল। মনসুর সাহেব বললেন—তোমাকে দেখি আর ভাবি প্রকৃতি মানুষকে কত বিচিত্র ক্ষমতা দিয়েই না পাঠিয়েছেন। রসিকতা করতে হলে তীক্ষ্ণবুদ্ধির প্রয়োজন। তুমি নির্বোধ। তারপরেও তুমি অসাধারণ সব রসিকতা কর। তোমাকে এই ক্ষমতা দিয়ে প্রকৃতি চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের একটা জিনিস বুঝিয়ে দেন—তা হচ্ছেদেখ আমাকে দেখ। দেখ কি করতে পারি। বদরুল যাই। শরীরটা ভালো লাগছে না। নয়ত আরো কিছুক্ষণ বসতাম।
তিনি সরাসরি বাসার দিকে রওনা হলেন। স্কুলে গেলেন। তাঁর পকেটে একটা দরখাস্ত সেখানে লিখলেন