মনসুর সাহেব ডাকলেন, ফিবোনাক্কি।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল, জ্বি স্যার আমি আছি।
হ্যাঁ সে আছে তো বটেই। ঐতো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চাদের মরা আলোয় সুদর্শন এক তরুণ দাঁড়িয়ে। তার দিকে তাকিয়ে আছে।
ফিবোনাক্কি।
জ্বি স্যার।
আমার কাগজের প্যাকেটতো তোমার কাছে ছিল।
জ্বি!
কোথায় সেগুলি?
নষ্ট করে ফেলেছি।
নষ্ট করে ফেলেছি মানে?
আপনি আমার উপর রাগ করলেন। আমার মনটা হল খারাপ। আমি মন খারাপটা ঝাড়লাম কাগজের উপর।
তুমি কি করলে—এতগুলি কাগজ কুচি কুচি করে ছিড়ে ফেললে?
জ্বি না। কাগজগুলি দিয়ে নৌকো বানিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছি।
কি বললে?
কাগজের নৌকা বানিয়ে নদীতে ভাসিয়েছি। অনেকগুলি নৌকা হয়েছে। দেখতে খুব ভালো লাগে। সকালে মর্নিং ওয়াক করার জন্যে যদি নদীর পাড়ে আসেন তাহলে দেখবেন। একটা নৌকাও নষ্ট হয়নি।
আচ্ছা।
নৌকাগুলি ছেড়েছিও আপনার প্রিয় রাশিমালা অনুযায়ী প্রথম ছাড়লাম একটা, তারপর একটা, তারপর একসঙ্গে দুটা। তারপর একসঙ্গে তিনটা, তারপর পাঁচটা।…
চুপ কর।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
ফিবোনাক্কি।
জ্বি স্যার।
সত্যি করে বলতে আমার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? মাথা খারাপের ব্যাপারটা আমাদের পরিবারে আছে। আমার দাদাজানের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
আমি জানি।
তুমি জান?
আমি শূন্য জগতের একজন, সবকিছুই আমার জানা থাকার কথা। আপনার দাদাজানের হঠাৎ পাগল হয়ে যাবার ব্যাপারটা আমি জানি…একদিন তিনি ছাদে পাটি পেতে ঘুমুচ্ছিলেন—হঠাৎ তাঁর স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ওগো ওঠ। আমার মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে…
মনসুর সাহেব ফিবোনাক্কিতে থামিয়ে দিয়ে বললেন—তুমি এসব জান কারণ তুমি এসেছ আমার কল্পনা থেকে। সঙ্গত কারণেই আমি যা তুমি তাই জানবে।
আপনার দাদাজানও আপনার মতো অঙ্ক করতে ভালোবাসতেন। তাই না স্যার।
হুঁ।
তার ট্রাংক ভর্তি ছিল গুটি গুটি হাতে লেখা কাগজ।
হুঁ।
স্যার আপনি কি সেইসব দেখেছেন?
দেখেছি। বেশির ভাগই উইপোকায় কেটে ফেলেছিল।
অল্প যা রক্ষা পেয়েছিল আপনি তা আপনার ফাইলে যত্ন করে রেখেছেন।
আমি রাখিনি। আমার বাবা রেখেছিলেন। বাবার কাছ থেকেই আমি পেয়েছি।
আপনার বাবাওতো স্যার অঙ্কের ছাত্র ছিলেন?
হুঁ। কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অঙ্কে এম. এ ডিগ্রি নেন। গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন।
আপনারা তাহলে তিনপুরুষের গণিতজ্ঞ।
হুঁ।
অঙ্কে তো আপনারও এম. এ ডিগ্রি আছে। আপনি নিজেও তো কালি নারায়ণ স্কলার।
হুঁ।
ইউনিভার্সিটি বা কলেজে ইচ্ছা করলেই আপনি ভালো চাকরি পেতে পারতেন, তা না করে স্কুলে চাকরি নিলেন–কেন?
চট করে পেয়ে গেলাম। ঝামেলা কম, নিরিবিলি–।
আপনার বাবাও ঝামেলা পছন্দ করতেন না। নিরিবিলি কাজ করতে চাইতেন। তিনিও তো অতি অল্প বয়সে মারা গেছেন।
হু।
তাঁর মৃত্যু কি স্বাভাবিক মৃত্যু, না অস্বাভাবিক মৃত্যু?
মনসুর সাহেব জবাব দিলেন না। তাঁর কপালে ঘাম জমছে। শরীর কঁপছে। ফিবোনাক্কি বলল-স্যার একটা জটিল রাশিমালার সমাধান আপনারা তিন পুরুষ ধরে চেষ্টা করছেন। চতুর্থ পুরুষ বলে আপনাদের কিছু নেই। কিছু করার হলে আপনাকেই করতে হবে। যদি কিছু করতে না পারেন তাহলে আপনাতেই সব শেষ। স্যার আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।
তুমি কেউ না। তুমি আমার অবচেতন মনের কল্পনা।
যদি কল্পনাও হয়ে থাকি তাতেও তো ক্ষতি নেই। কাজ হওয়া নিয়ে কথা।
তুমি কী ভাবে সাহায্য করতে চাও?
আপনি অনেক রাশিমালা নিয়ে কাজ করছেন—একটি রাশিমালা আছে যার যোগফল শূন্য।
অনেকগুলি রাশিমালার যোগফলই শূন্য।
ফিবোনাক্কি রাশিমালার একটি আছে যার ফলাফল শূন্য।
মনে পড়ছে না।
খুঁজে বের করুন।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মনসুর সাহেব বললেন, তোমাদের শূন্য জগতটা কেমন?
অন্য রকম। সে জগতে সবই শূন্য। সেখানে আনন্দ, দুঃখ, বেদনা কিছুই নেই।
আনন্দ, দুঃখ, বেদনা নেই। শূন্য জগত তো ভয়াবহ জগত।
স্যার আপনি ভুলে যাচ্ছেন-শূন্যের সঙ্গে অসীম সম্পর্কিত। আনন্দ, দুঃখ, বেদনা যেমন শূন্য—তেমনি একই সঙ্গে অসীম। আপনি রহস্যের খুব কাছাকাছি আছেন। খুব কাছাকাছি। আপনি নিজেও তা জানেন। জানেন না?
হ্যাঁ জানি।
স্যার আপনি খুব কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। রহস্যের খুব কাছাকাছি এসে মানুষ ভেঙে পড়ে। আপনার দাদাজান ভেঙে পড়েছিলেন। আপনার বাবার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে।
মনসুর সাহেবের শীত করতে লাগল। চৈত্র মাসের রাতে এরকম শীত লাগার কথা নয়।
স্যার আমি এসেছি আপনাকে সাহস এবং শক্তি জোগানোর জন্যে। তুমি আমার অবচেতন মনের ছায়া।
তাতে কোনো ক্ষতি নেই। আপনি কাজ শুরু করুন যে ভাবে বলছি সেই ভাবে…
থ্যাংক য়্যু।
স্যার আমি আপনাকে কি পরিমাণ ভালোবাসি তা আপনি জানেন না।
তুমি তো ভালোবাসবেই। তুমি আমারই অংশ।
সব সময় মানুষের নিজের অংশই যে মানুষকে ভালোবাসে তাতো নয়। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করে বেঁচে থাকে।
তোমাকে ধন্যবাদ। আচ্ছা শোন–আমি কি স্বপ্ন দেখছি?
আমি যে জগতে বাস করি সে জগতে স্বপ্ন ও বাস্তবের কোনো সীমারেখা নেই। স্বপ্ন যা বাস্তবও তা।
ফিবোনাক্কি!
জ্বি স্যার। তুমি কি চা বানাতে পার?
কেন বলুনতো?
তাহলে চা বানাতে বলতাম। চা খেয়ে অঙ্ক শুরু করতাম।
ফিবোনাক্কি হেসে ফেলল।
হাসছ কেন?
এমি হাসছি স্যার। আপনি চা খেতে পারবেন না। ঘরে চিনি নেই। আপনি চিনি ছাড়া চা খেতে পারেন না। তাছাড়া রাত প্রায় শেষ হতে চলল—কিছুটা হলেও বিশ্রাম আপনার দরকার।