বাঁধে তুলে দেই। খাড়া বাঁধ। একা উঠতে পারবেন না।
খুব পারব। তুমি আসবে না। বললাম…
মনসুর সাহেব দেখলেন তারপরেও ফিবোনাক্কি তাঁকে অনুসরণ করছে। মনসুর সাহেব বাসার কাছাকাছি এসে আবারো কড়া করে ধমক দিলেন। ফিবোনাক্কি বলল, ঠিক আছে স্যার আমি চলে যাচ্ছি। তবে কাছাকাছিই থাকব। যদি প্রয়োজন হয়…
ফিবোনাক্কি ক্লান্ত ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছে। গেট খুলে কম্পাউন্ডের ভেতর মনসুর সাহেব বললেন-হরমুজ ফিরে এসেছে। একদিন থাকার কথা বলে দুদিন কাটিয়ে এসেছে। মেয়ের বাড়ি থেকে আসার পর প্রথম কয়েকদিন হরমুজের মেজাজ খুব ভালো থাকে। আজ তার মেজাজ অত্যন্ত ভালো। কথা বলার জন্যে সে ছটফট করছে, বলার লোক পাচ্ছে না।
মনসুর সাহেবকে দেখে তার আনন্দ তীব্র হল। সে গ্যারাজের বারান্দায় কেরোসিনের চুলায় ভাত চড়িয়েছে। ডাল ইতিমধ্যে নেমে গেছে। ইচ্ছা করলে কয়েক টুকরা বেগুন ভেঙ্গে ফেলা যায়। ঘরে বেগুন আছে। তবে না ভাজলেও ক্ষতি নেই–ডাল ভাত দিলেই স্যারের চলবে। বেগুন ভাজা দেখলে উনি বিরক্ত হতে পারেন।
হরমুজ একগাল হেসে বলল, স্যার কেমন আছেন?
ভালো।
আপনারে নিয়া খুব চিন্তায় ছিলাম।
কেন?
আপনার খাওয়া দাওয়ার কি ব্যবস্থাকি খাইলেন, না খাইলেন।
কোনো অসুবিধা হয় নি। তোমার মেয়ে ভালো?
আপনের দোয়া স্যার। মেয়ে ভালো আছে। তবে স্যার শরীর দুর্বল। ডাক্তার ওষুধ একটা দিয়েছে সত্তুর টাকা দাম। চিন্তা করেন—নয় আঙ্গুলের এক বোল তার দাম সত্তুর টাকা।
মনসুর সাহেব প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়ে বললেন, একটা কাজ করে দিতে পারবে হরমুজ।
অবশ্যই পারব।
গেটের বাইরে গিয়ে দেখতে কোনো ছেলে আছে কি-না।
কি ছেলে?
যুবক এক ছেলে। আমার কাগজগুলি ছিল তার হাতে। পাঁচ দিস্তা কাগজ।
হরমুজ তৎক্ষণাৎ বের হয়ে গেল। লোকটাকে সে পেল না।
কেউ ছিল না?
জ্বি না কেউ ছিল না।
ভালো করে দেখেছ?
খুব ভালো করে দেখেছি।
স্যার খানা হয়ে গেছে দিয়ে দেব?
না। খিদে নেই। আজ কিছু খাব না।
মনসুর সাহেব রাত নটা বাজার আগেই ঘুমুতে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙল রাত দুটায়। আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাদের ক্ষীণ আলোয় সব কেমন ভৌতিক লাগছে। দীর্ঘকাল পর তার একটু ভয় ভয় করতে লাগল।
তিনি হারিকেন জ্বালালেন। ঘুম যখন ভেঙেছে তখন একটু কাজ করা যাক। ফাইলপত্র নিয়ে বসা যাক। অনেকদিন কিছু লেখা হয় নি। অবহেলা করা হচ্ছে। বয়স হচ্ছে—বয়সের প্রধান ধর্ম আলস্য। কাজ এড়ানোর অজুহাত খোজা। অথচ উল্টোটাই হওয়া উচিত ছিল। অল্প বয়স্করা আলস্য দেখাতে পারে তাদের হাতে সময় আছে। তাঁর হাতে সময় কই? বৃদ্ধরা কাজ করবে যন্ত্রের মতো কোননাদিকে তারা তাকাবে না। কারণ তাদের ঘণ্টা বেজে গেছে। ঢং টং টং ঘণ্টা বেজেই যাচ্ছে। একদিন শেষ ঘণ্টা বাজবে তখন…
আচ্ছা শূন্য জগতের ব্যাপারগুলি কেমন? ফিবোনাকি কথাটা মন্দ বলে নিমাত্রাহীন জগত হল—অসীম মাত্রার জগত। তাঁর পিপাসা বোধ হচ্ছে। লেবুর সরবত খেয়ে ঘুমতে যান নি। পিপাসা হবারই কথা। চিনি লেবু কিছুই কেনা হয়নি। আজও ছোটবাজারে গিয়ে শুধু কাগজ কিনে ফিরেছেন।
তাঁর একজন এ্যাসিসটেন্ট থাকলে মন্দ হত না। হরমুজের মতো এ্যাসিসটেন্ট না—ফিবোনাক্কির মতো এ্যাসিসটেন্ট। যার সঙ্গে কথা বলে আরাম পাওয়া যায়। যে যুক্তি নির্ভর কথা বলবে প্রয়োজনে ছোটখাটো কাজও করে দেবে। যেমন চট করে গ্লাস ভর্তি লেবুর সরবত নিয়ে এল। কাগজপত্র গুছিয়ে রাখল।
ভালো কথা, তিনি যে পাঁচ দিস্তা কাগজ কিনেছিলেন—সেই কাগজতো রয়ে গেছে ফিবোনাক্কির কাছে। স্পষ্ট মনে আছে—দুজন নৌকোয় বসে কথা বলছেন। কাগজের প্যাকেটটা ফিবোনাক্কির হাতে। নৌকা থেকে তিনি রাগ করে উঠে এলেন। প্যাকেট নেয়া হল না। বাসার কাছাকাছি এসে ফিবোনাক্কিকে ধমকে বিয়ে করলেন। প্যাকেট ফেরত নিতে ভুলে গেলেন।
কাগজ ছাড়া তিনি হারিকেন জ্বালিয়ে করবেন কি? মনসুর সাহেব বিরক্ত মুখে ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। এখান থেকে দেয়ালের বাইরের খানিকটা অংশ দেখা যায়। ফিবোনাক্কি কি আছে সেখানে?
আচ্ছা তিনি হাস্যকর চিন্তা করছেন কেন? কল্পনার মানুষকেই বাস্তব মানুষ হিসেবে ভাবতে শুরু করছেন। তাঁর কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মাথা খারাপ রোগ তাঁদের বংশে আছে। তাঁর দাদাজান চল্লিশ বছরে হঠাৎ একদিন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেলেন। রাতে ঘুমুচ্ছিলেন ঘুম ভেঙে স্ত্রীকে ডেকে তুলে বললেন, ওগো ওই। আমার মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে। আমার মাথায় পানি ঢাল। দাদিজান ভয়ে অস্থির হয়ে পানি আনতে গেলেন। দাদাজান বললেন—বউ শোন পানি আনতে যাবার আগে দড়ি এনে আমাকে খাটের সঙ্গে বেঁধে রাখ, নয়ত দেখবে আমি ঝাপ দিয়ে দোতলা থেকে নিচে পড়ে গেছি। পাগল মানুষতো কিছুই বলা যায় না।
মনসুর সাহেবের দাদিজান দড়ি আনার আগে বালতি ভর্তি পানি এনে দেখেন মানুষটা বিছানায় নেই। ছাদ থেকে লাফিয়ে নিচে পড়েছে। তখনো জ্ঞান আছে। কথা বলতে পারছে। মৃত্যুর আগে মানুষটা বিড়বিড় করে বলল তোমার মনে কোনো কষ্ট রাখবে না। এটা আত্মহত্যা না। আমি আত্মহত্যার মানুষ না। মাথা খারাপ হয়ে গেছে বলে এই কাজ করেছি। মাথাটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। বড় আফসোস।
তার মাথাটাও কি হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছে? তিনি নিশিরাতে বারান্দায় দাড়িয়ে ফিবোনাক্কি নামক কল্পনার এক যুবককে ভাবতে শুরু করেছেন।