স্যার কেমন আছেন?
ভালো।
অনেকদিন পর আপনাকে দেখলাম। রোগা হয়ে গেছেন।
শরীর তেমন ভালো যাচ্ছে না।
কি স্যার।
চোখে সমস্যা, তারপর তোমার ইদানিং প্রেসারও সম্ভবত বেড়েছে। নরম্যালের চেয়ে বেশি।
খুব হাঁটাহাঁটি করবেন। প্রেসার আর ডায়াবেটিস এই দুইয়ের একটাই ওষুধ-হন্টন।
ফিবোনাক্কি হঠাৎ কথা বলল, ভাই আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। আমার নাম ফিবোনাক্কি।
কি নাক্কি।
ফিবোনাক্কি। একটু অদ্ভুত নাম।
আপনি কে?
আমিও আপনার মতোই আপনার স্যারের ছাত্র।
ও।
ফিবোনাক্কি হাসতে হাসতে বলল, ছাত্রে ছাত্রে ধুল পরিমাণ। ছাত্রে ছাত্রে ধুল পরিমাণ, মানে কি?
কথার কথা বললাম। সব কথাকে গুরুত্ব দিতে নেই। ভাই আপনি এখন চলে যান। আমরা হাঁটা শুরু করি। স্যারের সঙ্গে খুব জরুরি কিছু কথা আছে।
আপনার নামটা কি যেন বললেন–?
ফিবোনাক্কি।
আপনি কি বাঙালি।
এই মুহূর্তে ১০০ ভাগ বাঙালি। জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইনও জানি। শুনবেন?
জি না।
শুনুন না। ভালো লাগবে–।
জ্বি না কবিতা শুনব না।
তাহলে আপনি আর আপনার স্যারকে আটকে রাখবেন না। ছেড়ে দিন। উনার সঙ্গে আমার ভয়াবহ ধরনের জরুরি কিছু কথা আছে।
মনসুর সাহেব নিঃশব্দে হাঁটছেন। ফিবোনাক্কি হাঁটছে তার পাশে পাশে। ফিবোনাক্কি বলল, স্যার আপনার পরীক্ষার ফলাফল তো মনে হয় পজেটিভ। আপনার ঐ ছাত্রতো আমাকে দেখতে পেল এবং কথাবার্তাও বলল।
হু।
এখন কি আপনি মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন যে আমার একটা অস্তিত্ব আছে। আমি কল্পনার কেউ না।
মনসুর সাহেব কিছু বললেন না।
স্যার বাঁধের নিচে নৌকা বাঁধা আছে। খালি নৌকা। ঐখানে একটু বসবেন? জরুরি কথা দ্রুত সেরে ফেলতাম।
ঢালু বাঁধ। নামতে কষ্ট। ফিবোনাক্কি মনসুর সাহেবের হাত থেকে কাগজের প্যাকেট নিয়ে নিল। মনসুর সাহেবকে হাত ধরে সাবধানে নামাল।
দুজন চুপচাপ নৌকার গলুইয়ে মুখোমুখি বসে আছে। প্রথম কথা বললেন। মনসুর সাহেব বল কি বলবে?
স্যার আপনি খুব বড় একটা কাজ করছেন। কত বড় কাজ যে করছেন সেই সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই। আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।
তুমি কে?
আমি এসেছি শূন্য জগত থেকে।
মনসুর সাহেব দীৰ্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। সবই কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। ফিবোনাক্কি বলল, আমার জগতটা কি আমি ব্যাখ্যা করব?
করতে পার।
আপনার ভেতর কোনো আগ্রহ দেখছি না। আপনি যদি কোনো আগ্রহ না দেখান তাহলে আমি কথা বলে আরাম পাব না।
আগ্রহ বোধ করছি না বলেই তুমি আগ্রহ দেখছ না।
আগ্রহ না দেখালেন-কি বলছি মন দিয়ে শুনুন।
শুনছি।
স্যার এই পৃথিবীর বস্তু জগৎ হচ্ছে ত্রিমাত্রিক। পৃথিবীর বস্তু জগতের প্রতিটি বস্তুর আছে তিনটি মাত্রা–দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা। ঠিক না স্যার।
হ্যাঁ।
আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি থেকে সময় নিয়ে এসে, সময়কে একটা মাত্রা ধরে পৃথিবীর বস্তুজগতকে কেউ কেউ চার মাত্রার জগতও বলেন, তবে আমাদের বোঝার জন্যে পৃথিবীর জগতটাকে তিন মাত্রার জগত বলা চলে। ঠিক আছে স্যার?
হুঁ।
তিন মাত্রার জগতের মতো দুই মাত্রার জগততো হতে পারে। পারে না স্যার?
যে জগতে শুধু দৈৰ্ঘ্য আছে, প্রস্থ আছে। উচ্চতা বলে কিছু নেই।
থিওরিটেক্যালি থাকতে পারে।
দুই মাত্রার জগতের মতো একমাত্রার জগতও থাকতে পারে যে জগতের সব বস্তুর শুধু দৈৰ্ঘ্য আছে আর কিছু নেই। থাকতে পারে না স্যার?
হুঁ।
এখন তাহলে সবচে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে চলে আসুন। শূন্য মাত্রার জগত। তো থাকতে পারে। যে জগতে কোনো মাত্রা নেই। মাত্রা নেই বলে মাত্রার বন্ধনও নেই। শূন্য মাত্রার জগত এবং অসীম মাত্রার জগত কি একই নয়?
মনসুর সাহেব তাকিয়ে আছেন।
ফিবোনাক্কি বলল, শূন্য এবং অসীম এই দুটি সংখ্যার ধর্ম এক রকম। যে কোনো সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে গুণ করলে উত্তর হয় শূন্য। আবার যে কোনো সংখ্যাকে অসীম দিয়ে গুণ করলে উত্তর হয় অসীম। এখন স্যার আপনিই বলুন শূন্যকে অসীম দিয়ে গুণ করলে কি হবে?
মনসুর সাহেব ছোট্ট নিশ্বাস ফেললেন।
ফিবোনাক্কি বলল— আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি। আপনার সমাধান মানব জাতির জন্যে বিরাট ব্যাপার হবে। এই সমাধানের জন্যে মানুষ শূন্যের প্রবেশ…
মনসুর সাহেব তার কথা থামিয়ে মেঘস্বরে ধমকে উঠলেন–স্টপ।
ফিবোনাক্কি থমতো খেয়ে চুপ করে গেল। মনসুর সাহেব বললেন, তুমি কোনো কথা বলবে না। তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই। তুমি আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা…এর বেশি কিছু না।
একটু আগেই কিন্তু তৃতীয় এক ব্যক্তি—আপনার ছাত্র আমাকে দেখতে পেরেছে। আমার সঙ্গে কথা বলেছে।
আমার ঐ ছাত্রও আমার মনের কল্পনা। তুমি যেমন আমার কল্পনা থেকে এসেছ—সেও এসেছে। সে যে আচরণ আমার সঙ্গে করেছে কোনো ছাত্র আমার সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করবে না। আমাকে উপদেশ দিচ্ছে। বলছে হন্টন করবেন। হন্টন আবার কি?
সামান্য রসিকতাও আপনার ছাত্র আপনার সঙ্গে করতে পারবে না?
পারা উচিত কিন্তু পারে না। আমার বত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে কোনো ছাত্র আমার সঙ্গে রসিকতা করেনি। তারচেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল ঘুঘুটে অন্ধকারে আমার সঙ্গে তার দেখা। সে অন্ধকারে আমাকে চিনে ফেলল?
কেমন করে চিনল?
মনসুর সাহেব উঠে পড়লেন। ফিবোনাক্কি বলল, স্যার চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ চলে যাচ্ছি। আর শোন খবৰ্দার আমার পেছনে পেছনে আসবে না।