মনসুর সাহেব জবাব দিলেন না। হটাও শুরু করলেন না। ফিবোনাক্কির সঙ্গে হাঁটতে শুরু করা মানে তাকে শুধু যে স্বীকার করে নেয়া তাই না তাকে প্রশ্রয় দেয়া। স্বীকার করা বা প্রশ্রয় দেয়া কিছুতেই উচিত হবে না। মনের ভ্ৰান্তি মনেই থাকুক। তাঁর প্রেসার নিশ্চয়ই অনেক বেশি। ডাক্তার বজলুর রহমানের নষ্ট যন্ত্রে ধরা পড়ে নি। প্রেসার বেশি না হলে ফিবোনাক্কি নামক ব্যাপার স্যাপার চোখের সামনে উপস্থিত হত না।
স্যার ঐ রাতেতত এক ম্যারাথন ঘুম দিলেন। আমি হিসেব করে দেখেছি আপনি সর্বমোট ২৩ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট ১১ সেকেন্ড ঘুমিয়েছেন। আপনি কি স্যার লক্ষ করেছেন—২৩, ৩৭, ১১ তিনটাই প্রাইম নাম্বার। আবার এদের যোগফলও প্রাইম নাম্বার। এদের যোগফল হল ৭১, ইন্টারেস্টিং না?
হ্যাঁ ইন্টারেস্টিং। বেশ ইন্টারেস্টিং।
ফিবোনাক্কি লজ্জিত গলায় বলল, আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন স্যার। আসলে আপনি ঘুমিয়েছেন ২৫ ঘন্টা ২০ মিনিট চল্লিশ সেকেন্ড। কোনোটাই প্রাইম নাম্বার না। আপনাকে মিথ্যা করে প্রাইম নাম্বারের কথা বলেছি যাতে আপনি আগ্রহী হয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেন। প্রাইম নাম্বারের প্রতি আপনার এই আগ্রহের কারণ কি?
মনসুর সাহেব বললেন, একটা সংখ্যাকে উৎপাদকে বিশ্লেষণ করা যাচ্ছে না। অখণ্ড অবস্থায় থাকছে এই জন্যেই ভালো লাগে।
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যত গণিতবিদ জন্মেছেন সবারই প্রাইম নাম্বার সম্পর্কে কৌতূহল। ভারতের মাদ্রাজের এক গণিতবিদ ছিলেন—আপনি তাঁর নাম শুনেছেন রামানুজন?
হ্যাঁ শুনেছি।
প্রাইম নাম্বার সম্পর্কে উনার আগ্রহ ছিল সীমাহীন। উনার সেই বিখ্যাত গল্পটা কি স্যার জানেন?
কোন গল্প?
ঐ যে নিদারুণ অসুস্থ হয়ে তিনি শুয়ে আছেন। শরীরের এমন অবস্থা যে, যে কোনো মুহূর্তে তিনি মারা যাবেন। এই সময় তাঁকে এক ভদ্রলোক দেখতে এলেন। রামানুজন বললেন—তুমি যে গাড়িতে করে এসেছ তার নাম্বারটা কত। ভদ্রলোক নাম্বার বললেন। রামানুজন আনন্দিত ভঙ্গিতে বললেন-আরে প্রাইম নাম্বার! তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কি কৌতূহল।
মনসুর সাহেব রাগী গলায় বললেন, প্রাইম নাম্বার তুচ্ছ বিষয়?
অবশ্যই তুচ্ছ বিষয়। মৌলিক সংখ্যায় এমন কি বিশেষত্ব আছে যে একে মাথায় নিয়ে নাচতে হবে? পৃথিবীর রহস্যের সবটাই শূন্যের ভেতর। যে কোনো রাশিকে শূন্য দিয়ে গুণ দিলে উত্তর হবে ০, আবার সেই রাশিকে শূন্য দিয়ে ভাগ দিন হয়ে যাবে অসীম।
তুমি আমাকে এইসব শেখাতে এসো না। এসব আমার অজানা নয়।
স্যার আমরা হাঁটতে হাঁটতে গল্প করি?
চল।
আপনার কাগজের প্যাকেটটা আমার হাতে দিন।
তোমার হাতে দিতে হবে না—তুমি হাঁট। এটা এমন কিছু ভারি নয়।
ফিবোনাক্কি পাশপাশি হাঁটছে। নিজের উপর রাগে মনসুর সাহেবের গা জ্বলে যাচ্ছে। ফিবোনাক্কিকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটার মানে তাকে স্বীকার করে নেয়া।
ফিবোনাক্কি তুমি কি ধূমপান কর?
জ্বি না স্যার। তবে আপনি যদি দেন একটা সিগারেট টেনে দেখতে পারি।
আমার কাছে সিগারেট নেই, আমি ধূমপান করি না।
না করাই ভালো হার্টের বারোটা বাজিয়ে দেয়।
ফিবোনাক্কি।
জ্বি স্যার?
ব্যাঙের পেটে মণি থাকে তুমি জান?
আমি শুনেছি। ব্যাঙের পেটের মণিকে বলে–লাল। ভাদ্ৰ আশ্বিন মাসে ব্যাঙ এই লাল উগরে মাটিতে ফেলে। এতে জায়গাটা আলো হয়ে যায়। আলো দেখে পোকা মাকড় আসে। ব্যাঙ তখন এইসব পোকামাকড় ধরে ধরে খায়। এইসব কেন জিজ্ঞেস করছেন?
তোমার জ্ঞান কতটুকু তা জানার চেষ্টা করছি।
কি জানলেন?
জানলাম যে আমার যে জ্ঞান এবং তোমার যে জ্ঞান তা একই। তুমি আমার চেয়ে বেশি কিছু জান না। অর্থাৎ তুমি ফিবোনাকি নাও-কিছুই নও তুমি আমার কল্পনা। এবং এই সত্য আমি খুব সহজে প্রমাণ করতে পারি।
কীভাবে করবেন?
কাউকে না কাউকে আমি পাব যে নেত্রকোনার দিকে যাচ্ছে। তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করব সে তোমাকে দেখতে পাচ্ছে কি না। সে যদি তোমাকে দেখতে না পায় তাহলে তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই। তুমি আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের সৃষ্টি।
ফিবোনাক্কি চুপ করে রইল। মনসুর সাহেব বললেন আমার এই ক্ষুদ্র পরীক্ষা তোমার কাছে কেমন মনে হচ্ছে?
খুব ভালো পরীক্ষা স্যার!
তুমি কি এই পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে চাও?
অবশ্যই যেতে চাই। কেন যেতে চাইব না। পরীক্ষাটা হলে আমারই লাভ।
কি লাভ?
আপনি বুঝবেন যে আমি কল্পনা নই। আমার অস্তিত্ব আছে। এবং আমার কথা আপনার মন দিয়ে শোনা উচিত। আমি আপনাকে বিপদে ফেলার জন্যে বা বিভ্রান্ত করার জন্যে আসিনি। আমি আপনাকে সাহায্য করার জন্যে এসেছি।
মনসুর সাহেব কথা বললেন না। নিঃশব্দে হাঁটতে লাগলেন। এই মুহূর্তে একজন কাউকে তার প্রয়োজন যে নেত্রকোনা যাচ্ছে, বা নেত্রকোনা থেকে ফেরত আসছে।
কাকে যেন আসতে দেখা যাচ্ছে। বাঁধের উপর উঠে এল। সিগারেট বা বিড়ি টানছে। আগুনের ফুলকি উঠানামা করছে। মনসুর সাহেব দাঁড়িয়ে পড়লেন। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
ফিবোনাক্কির গলাতেও আগ্রহ ঝরে পড়ল, স্যার কেউ একজন আসছে।
মনসুর সাহেব এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করলেন। এই বয়সে উত্তেজনা ভালো না। তাছাড়া ডাক্তার বলে দিয়েছে তার প্রেসারের সমস্যা আছে নরম্যালের চেয়ে বেশি। প্রেসারের মানুষদের জন্যে উত্তেজনা-শুভ না।
সিগারেট টানতে টানতে যে আসছিল সে মনসুর সাহেবের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। সিগারেট ফেলে দিয়ে চুপ করে বসে মনসুর সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলল। মনসুর সাহেব চিনতে পারলেন না। অন্ধকারে চেনার কথাও না। তার পুরানো ছাত্রদের কেউ হবে। মনসুর সাহেব বললেন, থাক থাক সালাম লাগবে না। বলেই বিরক্ত হলেন—এই বাক্যটা সব সময় সালাম শেষ হবার পর বলা হয়। কাজেই এটা অর্থহীন বাক্য।