আমার ক্লাসে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
যান যান, ক্লাসে যান। ভালো কথা—ঐদিন ব্ল্যাকবোর্ড কি লিখেছিলেন?
বুঝতে পারছি না। কীসের কথা বলছেন?
ব্ল্যাকবোর্ড দেখলাম কি সব হাবিজাবি লেখা-ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ-খাঁজকাটা খাঁজকাটা সার্কেল…ছেলেদের বললাম, এইসব কে লিখেছে? ওরা বলল–আপনি।
মনসুর সাহেব চুপ করে রইলেন। তিনি নিজেও কিছু বুঝতে পারছেন না। হেডমাস্টার সাহেব বললেন, আচ্ছা যান, পরে এই নিয়ে কথা বলব। এটা এমন জরুরি কিছুও না। আপনার ব্লাডপ্রেসার নেই তো?
জানি না।
ব্লাডপ্রেসার থাকলে মাথায় মাঝে মাঝে ইয়ে হয়। আপনি বজলুকে দিয়ে প্রেসারটা মাপাবেন।
জ্বি আচ্ছা।
ওর প্রেসারের যন্ত্রপাতি ঠিক আছে কি-না কে জানে। ঐদিন প্রেসার মাপতে নিয়েছি, সে প্রেসার-ট্রেসার মেপে বলল—আবার মাপতে হবে। রিডিং ভুল আছে। আমি বললাম, কত আসছে? সে বলল ২৫। এখন আপনিই বলুন ২৫ কি কোনো প্রেসার? একটা মাঝারি সাইজের ইলিশ মাছের প্রেসারও পঁচিশের চেয়ে বেশি হয়।
মনসুর সাহেব পনেরো মিনিট দেরি করে ক্লাসে ঢুকলেন। প্রথমেই তাকালেন ববার্ডের দিকে। তারিখ এবং বার বোর্ডের মাথায় লেখা আছে। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ ছিল হয়তো হেডমাস্টার সাহেব তারিখ ভুল করছেন।
না, হেডমাস্টার সাহেব তারিখ ভুল করেন নি। তারিখ ঠিকই বলেছেন। মনসুর সাহেব রিপ ভ্যান উইংকেলের মতো পুরো চব্বিশ ঘণ্টাই ঘুমিয়েছেন।
মনসুর সাহেব বললেন, বাবারা, তোমরা কেমন আছ?
ছেলেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। মনসুর সাহেবের কাছ থেকে তারা এ জাতীয় কথা আগে শুনেনি।
আজ ক্লাসে আসতে দেরি করে ফেললাম। আজ আমরা কি পড়ব?
কোনো ছাত্র জবাব দিচ্ছে না। মনসুর সাহেব রেজিস্ট্রার খাতা খুলে ডাকলেন—রোল নাম্বার ওয়ান।
ক্লাস ক্যাপ্টেন উঠে দাঁড়াল।
তাকে প্রেজেন্ট মার্ক দিয়েই মনে হল—শূন্য কোনো প্রতীক না। শূন্য একটা সংখ্যা অথচ আমরা তাকে বাদ দিয়ে সংখ্যা শুরু করছি। এটা কি ঠিক হচ্ছে?
মনসুর সাহেব বললেন, রোল নম্বর ওয়ান, তোমার নাম কি?
মোহাম্মদ সাব্বির হোসেন।
শূন্য কাকে বলে সাব্বির হোসেন?
সাব্বির ভীত মুখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে শূন্য শব্দটা এই প্রথম শুনল।
শূন্য কাকে বলে তুমি জান না? জ্বি না। তোমরা কেউ জান?
মনসুর সাহেব ছাত্রদের মুখের দিকে তাকালেন। কেউ শব্দ করছে না। মনে হচ্ছে কেউ নিশ্বাস ফেলছে না।
আশ্চর্য ব্যাপার, তোমরা জান না শূন্য কি?
শূন্য হল স্যার গোল্লা।
মনসুর সাহেব বোর্ডে একটা চক্র আঁকলেন—সহজ গলায় বললেন, এই কি শূন্য?
জ্বি স্যার।
আচ্ছা শোন, আমার হাতের এই ডাস্টারটার দিকে তাকাও। ডাস্টারটা যদি আমরা ভাঙতে থাকি তাহলে ভেঙে কি পাব?
অণু পাব।
হ্যাঁ, অণু পাব। অণুটা যখন ভাঙব তখন কি পাব?
পরমাণু?
পরমাণু ভাঙলে?
ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন। এদের যদি ভাঙা যায় তাহলে কি পাব?
জানি না স্যার।
আমার ধারণা, ভাঙতে ভাঙতে এক সময় দেখব কিছুই নেই। এই জগৎ সংসার, বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড, গাছপালা, পৰ্বত-নদী সব তৈরি হয়েছে শূন্য দিয়ে সব কিছুই শূন্যের উপর। শুরুটা হল শূন্যে। যার শুরু শূন্যে তার শেষ কোথায়?
ছাত্ররা ভীত চোখে একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। মনসুর সাহেব বললেন–তার শেষও শূন্যে। বিশ্বজগৎ হল আঙটির মতো। আঙটির যেখানে শুরু সেখানেই শেষ। তোমরা কি বুঝতে পারছ?
সব ছেলে এক সঙ্গে মাথা নাড়ল। মনে হচ্ছে তারা সবাই ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে।
ক্লাসের ঘন্টা পড়ে গেছে। ঘণ্টা পড়ার পরেও ব্ল্যাকবোর্ড আঁকা বিশাল শূন্যের দিকে মনসুর সাহেব তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে ব্ল্যাকবোর্ডে তিনি অপরূপ কোনো চিত্র এঁকেছেন। চিত্রকলার সৌন্দর্য থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত করতে পারছেন না।
আকাশে চাঁদের আলো নেই
মনসুর সাহেব বাসার দিকে রওনা হলেন সন্ধ্যা মেলাবার পর। পথ অন্ধকার। আকাশে চাঁদের আলো নেই শুধু নক্ষত্রের আলো। নক্ষত্রের আলোয় পথ চলতে তাঁর ভালোই লাগছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শারীরবৃত্তির নিয়মে পরিবর্তন হয়—আলোর চেয়ে অন্ধকার বেশি ভালো লাগে।
বাঁধের উপর যে জায়গায় বজ্ৰপাত হয়েছিল মনসুর সাহেব ঐ জায়গাটা খুঁজতে শুরু করলেন। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছেন যেখানে বজ্ৰপাত হয়। সেখানে গর্ত হয়ে থাকে। গর্ত খুঁড়লে লৌহ জাতীয় কিছু পাওয়া যায়। বাঁধের উপর তিনি এমন কোনো গর্ত খুঁজে পেলেন না, যাকে বজ্ৰপাতজনিত গর্ত বলে ভাবা যায়। গরুর গাড়ির চাকায় তৈরি গর্ত, মাটি ডেবে যাবার গর্ত প্রচুর আছে; কিন্তু বজ্রপাতের গর্ত কই? তাঁর হাত থেকে কাগজের প্যাকেট পড়ে গিয়েছিল—সেই প্যাকেটটাই বা কোথায়?
স্যার কী খুঁজছেন?
মনসুর সাহেব চমকে উঠলেন। এতটা চমকানোর কোনো কারণ ছিল না। প্ৰশ্নকর্তা তাঁর অপরিচিত কেউ নয়। ফিবোনাক্কি। তিনি শুকনো গলায় বললেন, ও।
আমাকে চিনতে পেরেছেন তো স্যার আমি ফিবোনাক্কি।
হুঁ।
বজ্ৰপাতের জায়গাটা খুঁজছেন?
হুঁ।
ঐ রাতে বজ্ৰপাত হয়েছিল আপনার শরীরে। আপনার গা বেয়ে বিদ্যুৎ নিচে নেমে যায়।
আমার গায়ে বজ্ৰ পড়ল আর আমার কিছু হল না? তালগাছে বজ্ৰপাত হলে তালগাছ জ্বলে যায়।
স্যার আপনিতো আর তালগাছ না।
ফিবোনাক্কিও রসিকতা করছে। আশ্চর্য।
স্যার চলুন হাঁটা শুরু করি। গল্প করতে করতে আপনার সঙ্গে যাই। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।