তোমাকে উঠে আসতে হবে না—তুমি যেখানে আছ সেখানে থাক।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
আমি কি ভুল করছি বল।
স্যার বলব, তার আগে আপনি কাপড়গুলি বদলে শুকনো কাপড় পরে আসুন।
আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না। ভুল কি করেছি বল…
ভুল ঠিক না—একটা ব্যাপার আপনাদের চোখে পড়েনি।
বল কি সেটা।
আপনি শুকনো কাপড় না পরলে আমি বলব না।
মনসুর সাহেবের কৌতূহলই শেষ পর্যন্ত জয়ী হল। তিনি কাপড় ছাড়লেন। শুকনো কাপড় পরলেন। গায়ের কাদা এখনো আছে। থাকুক। তিনি জানালার কাছে মুখ নিয়ে ডাকলেন–ফিবোনাক্কি। ফিবোনাক্কি।
জ্বি স্যার।
কাপড় বদলেছি। আমার ভুলটা কি বল।
স্যার শূন্য এবং ১ এই দু-এর ভেতরের মিল কি আপনি লক্ষ করেছেন?
কি রকম মিল?
১×১=১
আবার
১×১x১= ১
একইভাবে ০ x০ = ০
০ X ০ x ০ = ০
১-এর বর্গমূল বা কিউব রুট যেমন ১
তেমনি ০-এর বর্গমূল বা কিউব রুটও ১।
মনসুর সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, এই সামান্য তথ্য আমার অজানা নয়।
ফিবোনাক্কি বলল, অনেক সময় সামান্যের মধ্যে অসামান্য লুকানো থাকে। এই দুটি সংখ্যার ভেতর রহস্যময় মিল আছে।
মিল আছে তো বটেই। রহস্যময় বলছ কেন?
জর(১) কে নিয়ে আপনারা মাথা ঘামাচ্ছেন। এর আলাদা নাম দিয়েছেন—কাল্পনিক সংখ্যা ইমাজিনারি নাম্বার। কিন্তু জর(-০) নিয়ে আপনাদের মাথাব্যথা নেই।
মাথাব্যথার কারণ নেই বলেই মাথাব্যথা নেই।
স্যার, আপনি খুব ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। আপনি ঘুমিয়ে পড়ন। একটা চাদরটাদর কিছু গায়ে দিয়ে ঘুমান। তুমি বিদেয় হও।
আমি তো বিদেয় হয়েই আছি। গেটের বাইরে ঠাণ্ডায় হাঁটাহাঁটি করছি। ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি।
তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই। তুমি হচ্ছ কল্পনা। আমার মনের কল্পনা। ঠিক বলিনি?
অবশ্যই ঠিক বলেছেন। আমি এসেছি শূন্য জগৎ থেকে। আমি তো শূন্য হবই। কল্পনাও শূন্য।
শাট আপ!
স্যার, ঘুমুতে যান। তবে আমাকে অনুমতি দিলে আমি ছোট্ট একটা কাজ করতে পারি। আমি দেয়াল বেয়ে উঠে এসে চারটা ভাত ফুটিয়ে দিতে পারি। দেয়াল বেয়ে উঠা আমার জন্যে কোনো সমস্যা নয়।
শাট আপ!
স্যার, আপনি এমন রাগারাগি করছেন কেন? রাগারাগি করা, গালাগালি করা এইসব তো আপনার মধ্যে কখনো ছিল না। স্যার, আপনার ঘুম দরকার। খুব ভালো ঘুম। আমি তো আপনার সঙ্গে কোনো অভদ্র ব্যবহার করছি না। অত্যন্ত ভদ্র ব্যবহার করছি। কথায় কথায় স্যার বলছি। আপনার কাছ থেকে সামান্য ভদ্ৰতা কি আমার প্রাপ্য নয়?
ফিবোনাক্কি, কিছু মনে করো না।
আমি কিছুই মনে করছি না। আমি বাইরেই আছি। আপনি ডাকলেই আমি আসব। স্যার, শুয়ে পড়ুন। আমি যদি আপনাকে কষ্ট দিয়ে থাকি তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
মনসুর সাহেব বিছানায় গেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে গেলেন। তাঁর ঘুম ভাঙল সকাল নটায়। ঘরে ঝলমলে রোদ। কাল রাতের কাণ্ডকারখানা মনে হয়ে তাঁর হাসি পেতে লাগল।
তাঁর ঠাণ্ডা লাগেনি। শরীর ভালোই আছে। প্রচণ্ড ক্ষুধাবোধ হচ্ছে। দশটায় স্কুল। চারটা খেয়ে স্কুলে যেতে হবে। তার আগে গোসল করতে হবে। কাদা শুকিয়ে শরীরে শক্ত হয়ে গেলে বসে আছে।
স্কুলে পা দিতেই হেডমাস্টার সাহেবের সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন—শরীর ঠিক আছে?
মনসুর সাহেব হাসলেন। হেডমাস্টার সাহেব বললেন বজলুর সঙ্গে দেখা। সে আপনাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করছিল। আপনি না-কি ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বের হয়ে পড়েছিলেন। কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
জ্বি না।
চোখের সমস্যা দূর হয়েছে?
জ্বি।
গতকাল স্কুলে না আসায় খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম। আপনি তো স্কুলে না। আসার লোক না। ভেবেছিলাম, আজও যদি না আসেন তাহলে খোঁজ নিতে যাব।
মনসুর সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, আজ ক তারিখ?
আঠারো তারিখ।
আঠারো তারিখ? আজ কি মঙ্গলবার।
হ্যাঁ। তারিখ জিজ্ঞেস করছেন কেন?
মনসুর সাহেব ফ্যাকাশে ভঙ্গিতে হাসতে চেষ্টা করলেন। তিনি তারিখ জিজ্ঞেস করছেন সঙ্গত কারণেই। হেডমাস্টার সাহেবের কথা শুনে মনে হচ্ছে তিনি চব্বিশ ঘণ্টা এক নাগাড়ে ঘুমিয়েছেন। মাঝখানের একটা দিনের কোনো হিসেব নেই।
হেডমাস্টার সাহেব বললেন, কি ব্যাপার, এমন করে তাকাচ্ছেন কেন?
শরীরটা ভালো বোধ হচ্ছে না।
শরীর ভালো না লাগে এসেছেন কেন? আপনারা সিনিয়র লোক। দুদিন পর রিটায়ার করবেন—বিশ্রাম তো আপনাদের প্রাপ্য।
মনসুর সাহেব বিরক্ত বোধ করছেন। ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। ক্লাসে যাওয়া দরকার। যে ধরনের আলাপ শুরু হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে না হেডমাস্টার সাহেব সহজে থামবেন। মনসুর সাহেব বললেন, ক্লাসের ঘন্টা পড়ে গেছে। স্যার।
পড়ক না। ঘণ্টা তো পড়বেই। জীবনেরই ঘণ্টা পড়ে গেছে আর ক্লাস! রবার্ট ব্রাউনিং-এর এই বিষয়ে একটা কবিতা আছে Ring Ring-ding ding…না, এটা বোধহয় ব্রাউনিং-এর না—অন্য কারো।
যদি অনুমতি দেন ক্লাসে যাই।
ক্লাসে যাবেন তার আবার অনুমতি কি? আপনার পাংচুয়ালিটির কথা আমি সর্বত্র বলি। সবাইকে বলি–এই লোকটাকে দেখ। দেখে শেখ। শিক্ষার জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন। কটা পুরুষ পারে? চিরকুমার একজন মানুষ।
আমি চিরকুমার না। বিবাহ করেছিলাম। অল্পবয়সে স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে। তারপর আর বিবাহ করিনি।
ঐ একই হল। স্ত্রীর মৃত্যুর পর বিয়ে করে না এমন লোক আমাকে দেখান তো। বুড়ো হাবড়াগুলি চক্ষুলজ্জায় বিয়ে করতে পারে না—এ ছাড়া সবাই করে। আমার এক শ্যালক আছে। ক্যানসারে তার স্ত্রী মারা গেল। শোকে সে উন্মাদ। রাতে ঘুমায় না। হাঁ হাঁ করে কাঁদে। মনে হয় হায়না ডাকছে। কী গভীর প্ৰেম! দশ দিনের মাথায় শুনি—সে বিয়ের জন্যে মেয়ে খোঁজাখুঁজি করছে। শালা বলে গালি দিতে ইচ্ছা করে। গালি কি দেবসে আসলেই আমার শালা। আপন শালা।