ছেলেটি বলল, কারা?
এই বাড়িতে যারা থাকত?
বাড়ি ছাইড়া নতুন বাড়িতে গেছে।
কোথায় গেছে?
আমি ক্যামনে কই?
বাড়িওয়ালার কাছে খোঁজ নিয়ে জানলেন—তারা পল্লবীতে বাড়ি নিয়েছে। বড় বাড়ি। সে বাড়ির ঠিকানা তিনি জানেন না।
অনেক যন্ত্ৰণা করে রাত দশটায় পল্লবীর বাড়িতে তিনি উপস্থিত। রাহেলা খড়খড়ে গলায় বললেন, এতক্ষণে তোমার সময় হল? আজ বাড়ি বদল হচ্ছে, কোথায় সকাল সকাল ফিরবে। সাহায্য করবে। আর তুমি কি না উদয় হয়েছ। মাঝরাতে।
বাড়ি বদল করছ জানতাম না। তুমি আমাকে কিছু বলেনি।
সব কিছু তোমাকে জানিয়ে তোমার অনুমতি নিয়ে করতে হবে?
না তা না। মানে আমি জানতাম না যে বাড়ি বদল করছ।
রোজ এই নিয়ে কথা হচ্ছে। জিনিসপত্র বাঁধাছাদা হচ্ছে—আর তুমি বলছ তুমি জানতে না।
কিছু তো বলেনি… আর কীভাবে বলব? মাইক ভাড়া করে বলতে হবে?
নতুন বাড়ির ঠিকানাও জানতাম না-খুব যন্ত্রণা করে ঠিকানা বের করেছি।
যন্ত্রণা করে ঠিকানা বের করতে হয়েছে? কী এমন যন্ত্রণা করেছ শুনি। হাতে ওটা কী?
সন্দেশ।
সন্দেশ কিনলে কেন?
এম্নি কিনলাম।
জানো এই বাড়িতে মিষ্টি কেউ খায় না-তারপরেও সন্দেশ কিনে আনলে কী মনে করে?
ভুল হয়ে গেছে।
নতুন বাসায় মতিন সাহেবের ঘর হল ছাদের চিলেকোঠায়। এই ঘরটা আগের চেয়েও ছোট তবে প্রচুর আলো-বাতাস। সবচে বড় সুবিধা হচ্ছে যে কোন সময় ছাদে আসা যায়। রাতে কোন কারণে তাঁর ঘুম ভাঙলেই তিনি ছাদে এসে বসে থাকেন। তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবেন, কেন সবাই তাকে এত অপছন্দ করে। তিনি কি মানুষটা খারাপ?
তা তো না। কখনো কোন অন্যায় করেছেন বলে তো মনে পড়ে না। সম্ভাবে থেকেছেন। সৎ জীবন যাপন করেছেন।
তাহলে কি তার চেহারা খারাপ? কিংবা চেহারাটা এমন যে দেখলেই সবার রাগ লাগে?
তাও বোধ হয় না। আয়নায় তিনি দীর্ঘ সময় নিজেকে দেখেছেন। একবার না, অনেকবার দেখেছেন। খারাপ বলে তো মনে হয় না। তাছাড়া চেহারা কি খুব বড় ব্যাপার? কত কুৎসিত দর্শন মানুষ পৃথিবীতে আছে। তাদের প্রতি কত ভালবাসা সবাই দেখায়। তাঁদের অফিসেই তো একজন আছেন, পরিমল বাবু। আগুনে পুড়ে মুখের একটা দিক ঝলসে গেছে, বা চোখটা নষ্ট। তাকালে শিউরে উঠতে হয়। অথচ সবার মুখে পরিমলদা, পরিমলদা। অফিসের পিকনিক হবে, ব্যবস্থা করবে পরিমলদা। নাটক দেখতে যাবে, ডাকো পরিমলদাকে।
তাহলে ব্যাপারটা কী? তিনি খানিকটা বোকা বলেই কি সবাই তাকে এড়িয়ে চলে? বোকাদের কেউ পছন্দ করে না—কিন্তু তিনি কি সত্যি বোকা? কাউকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে। কাকে জিজ্ঞেস করবেন? জিজ্ঞেস করবার মত কোন বন্ধু তার নেই। কাজেই তিনি গভীর রাতে ছাদে বসে আকাশের তারা গোনেন।
দিনের বেলাটা তার অবশ্যি খুব ভাল কাটে। সকালে নাশতা শেষ করেই বের হয়ে পড়েন। এগারোটা পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করেন। বাচ্চাদের স্কুলগুলির সামনে দাঁড়ান। এক একদিন এক এক স্কুল। ছোট ছোট বাচ্চারা হৈচৈ করে স্কুলে ঢুকে। তার দেখতে বড় ভাল লাগে। এগারোটার দিকে রোদ কড়া হয়ে গেলে ঘুরতে আর ভাল লাগে না। কোন একটা পার্কে চলে যান। দুপুরটা কাটে পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে শুয়ে। দুপুরের খাবার তিনি পার্কেই খান। এক ছটাক বাদাম, এক গ্লাস পানি আর এক কাপ চা। কোন কোন দিন দুটা সিঙ্গারা, একটা কলা। সবই পার্কে পাওয়া যায়। দুপুরে তিনি যে বাড়িতে খেতে যান না এ নিয়ে কেউ তাকে কখনো কিছু বলে না।
রোদ একটু কমে গেলে বেলা চারটার দিকে তিনি আবার ঘুরতে বের হন। বাসায় ফিরে যান সন্ধ্যার দিকে—এই হচ্ছে মতিন সাহেবের রুটিন। বাসায় ফিরে জিজ্ঞেস করেন অফিস থেকে কোন চিঠি এসেছে কি না। বিদায় সভার খবরের জন্য তিনি এখনো মনে মনে অপেক্ষা করেন।
এক রোববারের কথা। চৈত্র মাস। ঝাঁঝালো রোদ উঠেছে। মতিন সাহেব যথারীতি রমনা পার্কে উপস্থিত হয়েছেন। পছন্দসই একটা বেঞ্চ বের করে লম্বা হয়ে শুয়েছেন। আকাশ ঘন নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন হঠাৎ কেমন যেন হল। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ ঝাঁকুনি অনুভব করলেন। পেটের নাড়িভুঁড়ি মনে হল হঠাৎ একটা পাক দিয়েছে। মুখ ভর্তি হয়ে গেল লালায়। চোখের সামনে তীব্ব নীল আলো ঝলসে উঠল।
তিনি চোখ বন্ধ করে তিনবার বললেন, ইয়া মাবুদ, ইয়া মাবুদ, ইয়া মাবুদ।
চোখ খুললেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। যা দেখলেন তার জন্যে তাঁর কোন রকম মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। তিনি দেখলেন—তার চারপাশে ছসাতটি শিশু। বয়স সাত থেকে বারোর মধ্যে। প্রতিটি শিশুর মুখ এত সুন্দর যে মনে হয় যেন তুলি দিয়ে আঁকা। গায়ের রঙ গোলাপি, পাতলা ঠোট, গা লাল রঙের। চোখের পল্লব দীর্ঘ। চোখগুলি বড় বড়। সেই চোখে মুগ্ধ বিস্ময়।
মতিন সাহেব চোখ মেলতেই সবগুলি বাচ্চা এক সঙ্গে কলকল করে উঠল। তারা কথা বলছে। অতি বিচিত্র কোন ভাষায় কথা বলছে। সেই বিচিত্র ভাষার এক বৰ্ণও তিনি বুঝতে পারছেন না। তারা কথা বলছে অতি মিষ্টি সুরে। খানিকটা টেনে টেনে। এক-একটা বাক্য বলার পর তারা বা হাত চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে—এটাই বোধ হয় এদের কথা বলার ভঙ্গি।
এরা যে মানবশিশু এতে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু কোথাকার মানবশিশু? এদের পোশকও অতি বিচিত্র। সবারই গলা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা পোশাক। যার রঙ কোন স্থায়ী রঙ না ক্ষণে ক্ষণে তা বদলাচ্ছে।