আজ বৃহস্পতিবার, হাফ স্কুল। আগামীকাল ছুটি। ছাত্র-শিক্ষক সবার মধ্যেই একটা ছুটি-ছুটি ভাব চলে এসেছে। থার্ড পিরিয়ডে অমর বাবুর ক্লাস নেই। তিনি জানালার কাছের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। ইরিস সাহেব তাঁর সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, তারপর অমর বাবু, আপনার সায়েন্সের কি খবর?
অমর বাবু কিছু বললেন না তবে চোখ তুলে তাকালেন। মনে মনে রসিকতার জন্য প্রস্তুত হলেন। বিজ্ঞান নিয়ে এই লোকটি কঠিন রসিকতা করে যা তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না।
ইরিস সাহেব পানের কৌটা থেকে পান বের করতে করতে বললেন, অনেকদিন থেকে আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরছে। রোজই ভাবি আপনাকে জিজ্ঞেস করব।
জিজ্ঞেস করলেই পারেন।
ভরসা হয় না। আপনি তো আবার প্রশ্ন করলে রেগে যান।
বিজ্ঞান নিয়ে রসিকতা করলে রাগি। এমনিতে রাগি না—আপনার প্রশ্নটা কি?
ইদরিস সাহেব পান চিবুতে চিবুতে বললেন, পৃথিবী যে ঘুরছে এই নিয়ে প্রশ্ন। পৃথিবী তো ঘুরছে, তাই না?
জি। পৃথিবীর দুরকম গতি-নিজের অক্ষের উপর ঘুরছে, আবার সূর্যের চারদিকে ঘুরছে।
বাঁই বাঁই করে ঘুরছে?
জ্বি?
তাই যদি হয় তাহলে আমাদের মাথা কেন ঘুরে না? মাথা ঘোরা উচিত ছিল না? এমনিতে তো মাঠে দুটো চক্কর দিলে মাথা ঘুরতে থাকে। ওকি, এরকম করে তাকাচ্ছেন কেন? রাগ করছেন না-কি?
বিজ্ঞান নিয়ে রসিকতা আমি পছন্দ করি না।
রসিকতা কি করলাম?
অমর বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। ঘন্টা পড়বার আগেই ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এই তার নিয়ম। পৃথিবী কোনো কারণে হঠাৎ উল্টে গেলেও নিয়মের ব্যতিক্রম হবে না।
আজ পড়ার বিষয়বস্তু হল আলো। আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ। বড় চমকার বিষয়। আলো হচ্ছে একই সঙ্গে তরঙ্গ ও বস্তু। কী অসাধারণ ব্যাপার। ক্লাস টেনের ছেলেগুলি অবশ্যি এসব বুঝবে না। তবে বড় হয়ে যখন পড়বে তখন চমৎকৃত হবে।
অমর বাবু ক্লাসে ঢুকেই বললেন, আলোর গতিবেগ কতকে বলতে পার? সাতজন ছেলে হাত তুলল। তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। তার ধারণা ছিল সবাই হাত তুলবে। ছেলেগুলি কি সায়েন্সে মজা পাচ্ছে না? তা কি করে হয়?
পৃথিবীতে মজার বিষয় তো একটাই। সায়েন্স।
তুমি বল, আলোর গতিবেগ কত?
প্রতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল।
ভেরি গুড। এখন তুমি বল, আলোর গতি কি এর চেয়ে বেশি হতে পারে?
জ্বিনা স্যার।
কেন পারে না।
এটাই স্যার নিয়ম। প্রকৃতির নিয়ম।
ভেরি গুড। ভেরি ভেরি গুড। প্রকৃতির কিছু নিয়ম আছে যে নিয়মের কখনো ব্যতিক্রম হবে না। হতে পারে না। যেমন মাধ্যাকর্ষণ। একটা আম যদি গাছ থেকে। পড়ে তাহলে তা মাটিতেই পড়বে, আকাশে উড়ে যাবে না। ইজ ইট ক্লিয়ার?
জি-স্যার।
মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জনক কে?
নিউটন।
নামটা তুমি এইভাবে বললে যেন নিউটন হলেন একজন রাম-শ্যাম, যদুমধু, রহিম-করিম। নাম উচ্চারণে কোনো শ্ৰদ্ধা নাই—বল মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন।
ছাত্রটা কাঁচুমাচু মুখে বলল, মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন।
একজন অত্যন্ত শ্ৰদ্ধেয় বিজ্ঞানীর নাম অশ্রদ্ধার সঙ্গে বলার জন্যে তোমার শাস্তি হবে। ক্লাস শেষ হলে বাড়ি যাবে না, পাটিগণিতের বার নম্বর প্রশ্নমালার একুশ আর বাইশ এই দুটি অঙ্ক করে তারপর যাবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?
ছেলেটির মুখ আরো শুকিয়ে গেল।
অমর বাবুর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ছেলেগুলি তাঁর মন খারাপ করিয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞান অবহেলা করছে। অশ্রদ্ধার সঙ্গে পড়ছে। খুবই দুঃখের কথা।
সন্ধ্যার পর তিনি স্কুল লাইব্রেরিতে খানিকক্ষণ পড়াশোনা করলেন। বিজ্ঞানী নিউটনের জীবনকথা। মনের অশান্ত ভাব একটু কমল। তিনি স্কুলের দোতলায় নিজের ঘরে ফিরে এলেন। তাঁর ছোট ছেলে রতন টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে এসেছে। মুখ কাচুমাচু করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে তার বাবাকে স্কুলের ছাত্রদের চেয়েও বেশি ভয় করে।
রতন কিছু বলবি?
মা বলছিলেন, অনেকদিন আপনি বাড়িতে যান না।
তাতে অসুবিধা তো কিছু হচ্ছে না।
মার শরীরটা ভালো না। জ্বর।
ডাক্তার ডেকে নিয়ে যা। আমাকে বলছিস কেন? আমি কি ডাক্তার।
রতন মাথা নিচু করে চলে গেল। অমর বাবুর মনে হল আরেকটু ভালো ব্যবহার করলেই হত। এতটা কঠিন হবার প্রয়োজন ছিল না। কঠিন না হয়েই বা কি করবেন—গাধা ছেলে-মেট্রিকটা তিনবারেও পাস করতে পারেনি। জগতের আনন্দময় বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলি কিছুই জানল না—আলো কি সেই সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। আলো কি জিজ্ঞেস করলে নিৰ্ঘাৎ বলবে—এক ধরনের তরকারি, ভর্তা করেও খাওয়া যায়। ছিঃ ছিঃ।
ঘড়ি ধরে ঠিক নটায় তিনি রাতের খাবার শেষ করলেন। খাওয়া শেষ করতেই কেঁপে বৃষ্টি নামল। খোলা জানালা দিয়ে হু-হু করে হাওয়া আসতে লাগল। মেঘ ডাকতে লাগল। অমর বাবু দরজা-জানালা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসলেন। তাঁর ঘুমুতে যাবার সময় বাধা আছে রাত দশটা কুড়ি। এখনো অনেক বাকি আছে। এই সময়টা তিনি চুপচাপ বসে নানা বিষয় ভাবেন। ভাবতে ভালো লাগে। আগে পড়াশোনা করতেন। এখন চোখের কারণে হারিকেনের আলোয় বেশিক্ষণ পড়তে পারেন না। মাথায় যন্ত্রণা হয়। ঢাকায় গিয়ে ভালো ডাক্তার দিয়ে চোখ দেখানো দরকার।
তিনি বিছানায় পা তুলে উঠে বসলেন। শীত-শীত লাগছিল, গায়ে একটা চাদর জড়াবেন কি-না যখন ভাবছেন তখন হঠাৎ শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল। তিনি খানিকটা নড়ে উঠলেন। আর তখন অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার হল—তিনি লক্ষ করলেন বিছানা ছেড়ে তিনি উপরে উঠে যাচ্ছেন। প্রায় হাত তিনেক উঠে গেলেন এবং সেখানেই স্থির হয়ে গেলেন। চোখের ভুল? অবশ্যই চোখের ভুল। মহাবিজ্ঞানী নিউটনের সূত্র অনুযায়ী এটা হতে পারে না। হতে পারে না। হতে পারে না। নিতান্তই অসম্ভব। সূর্য পশ্চিম দিকে উঠা যেমন অসম্ভব, এটাও তেমনি অসম্ভব। এ হতেই পারে না।