মতিন সাহেব কিছু বললেন না। তাঁর খুব যেতে ইচ্ছা করছে। নিজ থেকে বলতে ইচ্ছা করছে না, আপনারা যান। আমি থাকি।
শুনুন মতিন সাহেব, আপনি বরং থাকুন। আপনাকে পরে পাস এনে দেব। আর ছবিও খুব আজেবাজে। পুরা ছবি দেখলে হলের মধ্যে বমি করে দেবেন। না দেখাই ভাল।
মতিন সাহেব বললেন, আচ্ছা।
মনে কিছু করলেন না তো আবার?
জ্বি না।
বাসা পর্যন্ত চলুন। এক সঙ্গে চা খাই। অসুবিধা নেই তো?
জ্বি না।
শেষ পর্যন্ত বাসায় যাওয়া হল না। একটা জিপ জোগাড় হয়েছিল, সেই জিপে সবার জায়গা হল মতিন সাহেবের হল না।
মতিন সাহেব, আপনি রবং একটা রিকশা নিয়ে চলে আসুন। ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। মালিবাগ চৌধুরী পাড়া। অসুবিধা হবে না তো?
জ্বি না।
ঠিকানা নিয়ে তিনি রিকশা করে মালিবাগে নামলেন। বাসা খুঁজে পেলেন না কারণ ঠিকানায় সবই দেয়া আছে বাসার নাম্বার দেয়া নেই। মতিন সাহেবের একবার ক্ষীণ সন্দেহ হল-ইচ্ছা করেই বাসার নাম্বার দেয়নি। পর মুহূর্তেই সেই সন্দেহ তিনি ঝেড়ে ফেলে দিলেন। তা কী করে হয়। সন্ধ্যা না মেলানো পর্যন্ত তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করলেন বাড়ি খুঁজে বের করবার। পারলেন না।
সায়েন্স টিচার অমর বাবু
রূপেশ্বর নিউ মডেল হাইস্কুলের সায়েন্স টিচার হচ্ছেন অমর বাবু। (অমর নাথ পাল, বি. এসসি. (অনার্স, গোল্ড মেডেল)।
খুব সিরিয়াস ধরনের শিক্ষক। স্কুলের স্যারদের আসল নামের বাইরে একটা নকল নাম থাকে। ছাত্র মহলে সেই নামেই তারা পরিচিত হন। অমর বাবু স্কুলে ঘড়ি স্যার নামে পরিচিত। তাঁর বুক পকেটে একটা গোল ঘড়ি আছে। ক্লাসে ঢােকার আগে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘড়িতে সময় দেখে নেন। ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ামাত্র আবার ঘড়ি বের করে সময় দেখেন। তখন যদি তার ভুরু কুঁচকে যায় তাহলে বুঝতে হবে ঘণ্টা ঠিকমতো পড়েনি। দুএক মিনিট এদিক-ওদিক হয়েছে।
তার ক্লাসে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতে হবে। আসা যাবে না, পেনসিল দিয়ে পাশের ছেলের পিঠে খোচা দেয়া চলবে না। খাতায় কাটাকুটি খেলা চলবে না। মনের ভুলেও যদি কেউ হেসে ফেলে তিনি হতভম্ব চোখে তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলবেন, সায়েন্স ছেলেখেলা নয়। হাসাহাসির কোনো ব্যাপার এর মধ্যে নেই। সায়েন্স পড়াবার সময় তুমি হেসেছ, তার মানে বিজ্ঞানকে তুমি উপহাস করেছ। মহা অন্যায় করেছ। তার জন্যে শাস্তি হবে। আজ ক্লাস শেষ হবার পর বাড়ি যাবে না। পাটিগণিতের সাত প্ৰশ্নমালার ১৭, ১৮, ১৯ এই তিনটি অঙ্ক করে বাড়ি যাবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?
অপরাধী শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। তার লাঞ্ছনা দেখে অন্য কেউ হয়তো ফিক করে হেসে ফেলল। অমর স্যার থমথমে গলায় বলবেন, ওকি, তুমি হাসছ কেন? হাস্যকর কিছু কি বলেছি? তুমি উঠে দাড়াও। অকারণে হাসার জন্য শাস্তি হিসেবে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকবে।
অমর বাবু পকেট থেকে ঘড়ি বের করবেন। পাঁচ মিনিট তিনি এক দৃষ্টিতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইবেন। ছাত্ররা মূর্তির মতো বসে থাকবে।
অমর বাবুর বয়স পঞ্চাশ। স্ত্রী, দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে—এই নিয়ে তাঁর সংসার। দুটি ছেলেই বড় হয়েছে রূপেশ্বর বাজারে একজনের কাপড়ের ব্যবসা, অন্যজনের ফার্মেসি আছে। ভালো টাকা রোজগার করে। একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। অন্য মেয়েটির বিয়ের কথা হচ্ছে। এদের কারোর সঙ্গেই তাঁর বনে না। স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যাদের তিনি সহ্য করতে পারেন না। অনেক দিন হল বাড়িতেও থাকেন না। স্কুলের দোতলায় একটা খালি ঘরে বাস করেন। সেখানে বিছানা বালিশ আছে। একটা স্টোভ আছে। গভীর রাতে স্টোভে চা বানিয়ে খান।
রূপেশ্বর স্কুলের হেড স্যার তাকে বলেছিলেন, আপনার ঘর-সংসার থাকতে আপনি স্কুলে থাকেন, এটা কেমন কথা?
অমর বাবু গম্ভীর গলায় বললেন, রাত জেগে পড়াশোনা করি, একা থাকতেই ভালো লাগে। তাছাড়া ওদের সঙ্গে আমার বনে না। তবে স্কুলে রাত্রি যাপন করে যদি আপনাদের অসুবিধার কারণ ঘটিয়ে থাকি তাহলে আমাকে সরাসরি বলুন, আমি ভিন্ন ব্যবস্থা দেখি।
হেড স্যার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আরে না এই কথা হচ্ছে না। আপনার যেখানে ভালো লাগবে আপনি সেখানে থাকবেন।
তিনি অমর বাবুকে ঘাটালেন না। কারণ অমর বাবু অসম্ভব ভালো শিক্ষক। অঙ্কের ডুবোজাহাজ। ডুবোজাহাজ বলার অর্থ তাঁকে দেখে মনে হয় না তিনি অঙ্ক জানেন। ভাবুক ভাবুক ভাব আছে। ক্লাসে কোনো অঙ্ক তাকে করতে দিলে এমন ভাব করেন যেন অঙ্কটা মাথাতেই ঢুকছে না। তারপর পকেট থেকে গোল ঘড়ি বের করে ঘড়ির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে, চোখ বন্ধ করে মুখে মুখে অঙ্কটা করে দেন। স্কুলের অনেক ছাত্রের ধারণা এই ঘড়িতে রহস্য আছে। ঘড়ি অঙ্ক করে দেয়। ব্যাপার তা নয়। তাঁর ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটায় গণ্ডগোল আছে। কখনো দ্রুত যায় কখনো আস্তে তবে গড়ে সমান থাকে। এইটাই তিনি মাঝে মাঝে পরীক্ষা করেন।
অমর বাবুকে ভালো মানুষ বলা যেতে পারে তবে তিনি অমিশুক, কথাবার্তা প্রায় বলেন না বললেই নয়। কারোর সাতে-পাঁচেও থাকেন না। টিচার্স কমন রুমে জানালার পাশের চেয়ারটায় চুপচাপ বসে থাকেন। ঘন্টা পড়লে ক্লাসে রওনা হন। স্কুলের আরবি শিক্ষক মৌলানা ইদরিস আলী তাঁকে নিয়ে মাঝেমধ্যে ঠাট্টা-তামাশা করার চেষ্টা করেন। বিশেষ লাভ হয় না। তিনি ঠাট্টাতামাশা পছন্দ করেন না। কেউ ঠাট্টা করলে কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকেন।