জ্বি না, বুঝতে পারছি না।
মোদ্দা কথা হল, আপনার রোগটা মনে।
না—আমি নিজে বিজ্ঞানের শিক্ষক। আমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় বিচার-বিবেচনা করেছি। আমি যে শূন্যে উঠতে পারি এটা ভুল না। পরীক্ষিত সত্য।
মোটেও পরীক্ষিত সত্য নয়। আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি দেখেনি যে আপনি শূন্যে ভাসছেন। দেখলেও কথা ছিল, কেউ কি দেখেছে?
জ্বিনা।
আমি ট্ৰাংকুলাইজার জাতীয় কিছু ওষুধ দিচ্ছি। নিয়মিত খাবেন, ব্যায়াম করবেন। মন প্ৰফুল্ল রাখবেন। বিজ্ঞান নিয়ে কোনো পড়াশোনা করবেন না।
অমর বাবু দুঃখিত গলায় বললেন, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি; কিন্তু আমি যা বলছি সত্য বলছি।
ব্যাপারটা হয়তো আপনার কাছে সত্যি। কিন্তু সবার কাছে নয়। আপনি খুব ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করলেও এই সিদ্ধান্তে আসবেন।
অমর বাবু ভগ্নহৃদয়ে রূপেশ্বরে ফিরে এলেন। স্কুলে যোগ দিলেন না। কিছুদিনের মধ্যেই মাথা খারাপের সব লক্ষণ তার মধ্যে একে একে দেখা দিতে লাগল। বিড়বিড় করে কথা বলেন, একা একা হাঁটেন। হাঁটার সময় দৃষ্টি থাকে আকাশের দিকে। নিতান্ত অপরিচিত কাউকে দেখলে থমকে দাঁড়িয়ে যান, শান্ত গলায় বলেন, কিছু মনে করবেন না। আপনি কি নিউটনের গতিসূত্র জানেন?
পাগলের অনেক রকম চিকিৎসা করানো হল। কোনো লাভ হল না। বরং লক্ষণগুলি আরো প্রকট হওয়া শুরু করল। গভীর রাতে ছাত্রদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে উঁচু গলায় ডাকেন—জব্বার, ও জব্বার, ওঠে আয় তো বাবা। খুব দরকার।
জব্বার উঠে এলে তিনি করুণ গলায় বলেন, নিউটনের সূত্র মনে আছে? ভালো করে পড়। এস.এস, সি তে আসবে। সাথে অঙ্ক থাকবে ভূমি থেকে দশ ফুট উচ্চতায় ১ গ্রাম ভর বিশিষ্ট একটি আপেল ছাড়িয়া দিলে তার গতিবেগ পাঁচ ফুট উচ্চতায় কত হইবে? অঙ্কটা চট করে কর। মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ কত মনে আছে তো?
আমাদের সমাজ পাগলদের প্রতি খুব নিষ্ঠুর আচরণ করে। অমর বাবুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। বছর খানিক না ঘুরতেই দেখা গেল ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে দেখে বলছে—নিউটনের সূত্রটা কি যেন? অমর বাবু দাঁতমুখ খিচিয়ে এদের তাড়া করছেন। তারা মজা পেয়ে খুব হাসছে। কারণ তারা জানে পাগলরা শিশুদের তাড়া করে ঠিকই কখনো আক্রমণ করে না।
পৌষের শুরু। জঁকিয়ে শীত পড়েছে। এই শীতেও খালি গায়ে শুধু একটা ধুতি কোমরে পেঁচিয়ে অমর বাবু রাস্তায় রাস্তায় হাঁটেন। নিউটনের সূত্র মনে আছে কিনা এই প্রশ্ন তিনি এখন আর কোনো মানুষকে করেন না। পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গদের করেন। তারা প্রশ্নের উত্তর সঙ্গত কারণেই দেয় না। তিনি তখন ক্ষেপে যান।
রাত দশটার মতো বাজে। কনকনে শীত।
অমর বাবু দাঁড়িয়ে আছেন একটা কাঁঠাল গাছের নিচে। কাঁঠাল গাছের ডালে কয়েকটা বাদুড় ঝুলছে। তিনি বাদুড়গুলিকে নিউটনের সূত্র সম্পর্কে বলছেন। তখনই দেখা গেলহারিকেন হাতে হেড স্যার আসছেন। কাঁঠাল গাছের কাছে এসে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। অমর বাবুর দিকে তাকিয়ে দুঃখিত গলায় বললেন, কে অমর?
জ্বি স্যার।
কী করছেন?
বাদুড়গুলির সঙ্গে কথা বলছিলাম স্যার।
ও আচ্ছা।
এদের সঙ্গে কথা বললে মনটা হালকা হয়। ওদের নিউটনের সূত্রগুলি বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম।
এই শীতে বাইরে ঘুরছেন। বাসায় গিয়ে ঘুমান।
ঘুম আসে না স্যার।
হেড মাস্টার সাহেব ইতস্তত করে বললেন, ইয়ে অমর বাবু, এখনো কি আপনি শূন্যে ভাসেন?
জ্বি-না। ঢাকা থেকে আসার পর আর ভাসিনি। যদি আবার কখনো ভাসতে পারি–আপনাকে বলব। আমার এখানে থাকতে ইচ্ছে করে না। ভাসতে ভাসতে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে।
দূরে কোথায়?
মহাশূন্যে—অসীম দূরত্বে। চন্দ্ৰ সূৰ্য গ্ৰহ নক্ষত্র সব ছাড়িয়ে…
ও আচ্ছা।
যাবার আগে আমি আপনাকে খবর দিয়ে যাব।
আচ্ছা।
শীত কেটে গিয়ে বর্ষা
শীত কেটে গিয়ে বর্ষা এসে গেল। অমর বাবু লোকালয় প্রায় ত্যাগ করলেন। বেশির ভাগ সময় বনে-জঙ্গলে থাকেন। রূপেশ্বরের পাশের গ্রাম হলদিয়ায় ঘন বন আছে। এখন ঐ বনেই তাঁর আস্তানা। তাঁর মেয়ে অতসী প্রায়ই তাঁকে খুঁজতে আসে। পায় না। মেয়েটা বনে বনে ঘুরে এবং কাঁদে। তিনি চার-পাঁচদিন পর পর একবার বের হয়ে আসেন। তাঁকে দেখে আগের অমর বাবু বলে চেনার কোনো উপায় নেই। যেন মানুষ না-প্ৰেত বিশেষ। মাথাভর্তি বিরাট চুল, বড় বড় দাড়ি। হাতের নখগুলি বড় হতে হতে পাখির ঠোটের মতো বেঁকে গেছে। স্বভাব-চরিত্র হয়েছে ভয়ংকর। মানুষ দেখলে কামড়াতে আসেন। ইট-পাথর ছুড়েন। একবার স্থানীয় পোস্ট মাস্টারকে গলা টিপে প্রায় মেরে ফেলতে বসেছিলেন। সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। অতসীর বিয়ে হয়ে গেছে, সেও এখন আর বাবার খোঁজে আসে না।
দেখতে দেখতে এক বছর পার হয়ে গেল। কার্তিক মাস। অল্প অল্প শীত পড়ছে। এগারোটার মতো বাজে। হেড স্যার খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়েছেন, হঠাৎ শুনলেন উঠান থেকে অমর বাবু ডাকছেন—স্যার, স্যার-স্যার জেগে আছেন?
কে?
স্যার আমি অমর। একটু বাইরে আসবেন?
হেড স্যার অবাক হয়ে বিছানায় উঠে বসলেন। তাঁর স্ত্রী বললেন, খবরদার, তুমি বেরুতে পারবে না। পাগল মানুষকি না কি করে বসে। ঘুমাও।
অমর বাবু আবার কাতর গলায় বললেন, একটু বাইরে আসুন স্যার খুব দরকার। খুব বেশি দরকার।
হেড স্যার ভয়ে ভয়ে বাইরে এলেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন তাঁর বাড়ির সামনের আমগাছের সমান উচ্চতায় অমর বাবু ভাসছেন। অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় দৃশ্য। একটা মানুষ অবলীলায় শূন্যে ভাসছে। তার জন্যে পাখিদের মতো তাঁকে ডানা ঝাল্টাতে হচ্ছে না।