নিকি ঘরে ঢুকে থমকে গেল।
সারা গায়ে চাদর জড়িয়ে ফিহা শুয়ে আছেন। নটার মতো বাজে। এই সময় তিনি সাধারণত আঁক কষেন, নয়তো দুলেন্দুলে বাচ্চাদের মতো বই পড়েন। নিকি বলল, আপনার কি শরীর খারাপ হয়েছে?
ফিহা বললেন, শরীর নয়, মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কাল সারারাত আমি ভূত দেখেছি।
ভূত?
ভূত! হ্যাঁ, জ্বলজ্যান্ত ভূত। মানুষের গলায় কথা বলে। বাতি জ্বললেই চলে যায়। আবার ঘর অন্ধকার করলে ফিরে আসে। অদ্ভুত ব্যাপার। সকালবেলা শুয়েশুয়ে তাই ভাবছি।
নিকি বলল, রাত-দিন অঙ্ক নিয়ে আছেন। মাথাকে তো আর বিশ্রাম দিচ্ছেন না, সেই জন্যে এসব হচ্ছে। ভালো করে খাওয়াদাওয়া করুন; এক জন ডাক্তার আনব?
না না, ডাক্তার-ফাক্তার লাগবে না। আর বিশ্রামের কথা বলছ? সময় তো খুব অল্প। যা করতে হয়। এর ভেতর করতে হবে।
নিকি দেখল, ফিহা খুব সহজভাবে কথা বলছেন। সাধারণত দুটি কথার পরই তিনি রেগে যান। গালিগালাজ করতে থাকেন। রাগ খুব বেশি চড়ে গেলে হাতের কাছে যে কাগজটা পান তা কুচিকুচি করে ফেলেন। রাগ তখন একটু পড়ে। নিকি ভাবল, রাতে নিশ্চয়ই এমন কিছু হয়েছে, যার জন্যে আজ ফিহার গলায় এরকম নরম সুর। নিকি চেয়ারে বসতে বসতে বলল, কী হয়েছিল ফিহা! ভূতটা কি আপনাকে ভয় দেখিয়েছিল?
না, ভয় দেখায় নি। বরং খুব সম্মান করে কথা বলেছে। বলেছে, এই যে চারিদিকে রব উঠেছে মহাসংকট, মহাসংকট–এসব কিছু নয়। শুধুমাত্র পৃথিবীর ডাইমেনশন বদলে যাবে, আর নতুন ডাইমেনশনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুবর্ণ সুযোগ! এবং সেখানে নাকি আমার মতো বিজ্ঞানীর মহা সুযোগ-সুবিধা। কাজেই আমি যেন এমন কিছু না করি যাতে এই মহাসংকট কেটে যায়। এই সব।
আপনি তার কথা শুনে কী করলেন?
প্রথমে কাঁচের গ্লাসটা ছুঁড়ে মেরেছি। তার দিকে। তারপর ছুঁড়ে মেরেছি এ্যাসট্রেটা। এতেও যখন কিছু হল না, তখন বাতি জ্বলিয়ে দিয়েছি।
নিকি অবাক হয়ে বলল, আমার যেন কেমন কেমন লাগছে। সত্যি কি কেউ এসেছিল?
আরে না। আসবে আবার কি? ত্রিমাত্রিক জগৎকে চতুর্মাত্রিক জগতে পরিণত করবার জন্যে আমি এক সময় কতকগুলি ইকোয়েশন সমাধান করেছিলাম, জান বোধ হয়? গত কয়েক দিন ধরেই কেন জানি বারবার সে কথা মনে হচ্ছে। তাই থেকে এসব দেখছি। মাথা গরম হলে যা হয়। বাদ দাও ওসব। তুমি কি চা দেবে এক কাপ?
আনছি, এক্ষুণি নিয়ে আসছি।
রাত্রি জাগরণের ফলে ফিহা সত্যি সত্যি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আগে ভেবে রেখেছিলেন, আজ সমস্ত দিন কাজ করবেন এবং সমস্ত দিন কোনো খাবার খাবেন না। ফিহো সব সময় দেখেছেন যখন তাঁর পেটে এক কণা খাবার থাকে শ1, ক্ষুধায় সমস্ত শরীর অবসান হয়ে আসে, তখন তাঁর চিন্তাশক্তি অসম্ভব রকম বেড়ে যায়। বিস্ময়কর যে কয়টি আবিষ্কার তিনি করেছেন, তা ক্ষুধার্ত অবস্থাতেই করেছেন। আজ অবশ্যি কিছু করা গেল না। পরিকল্পনা অনুযায়ী নিকি সকালের খাবার দিয়ে যায় নি। গত রাতে যদি এই জাতীয় আধিভৌতিক ব্যাপার গুলি না। ২৩ তাহলে এতক্ষণে কাজে লেগে পড়তেন।
এই নিন চা। আমি সঙ্গে কিছু বিস্কিটও নিয়ে এসেছি।
খুব ভালো করেছ। নিকি একটু ইতস্তত করে বলল, ফিহা, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।
বল, বল।
আগে বলুন আপনি হাসবেন না?
হাসির কথা হলেও হাসব না?
হাসির কথা নয়। আমি–মানে আমার মনে কদিন ধরেই একটা ভাবনা হচ্ছে, আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না।
ফিহা বললেন, বলেই ফেল। কোনো প্রেমের ব্যাপার নাকি?
না না, কী যে বলেন! আমার মনে হয় আমরা যদি পৃথিবীটাকে সরিয়ে দিতে পারি তার কক্ষপথ থেকে, তাহলে বিপদ থেকে বেচে যেতে পারি। নয় কি?
ফিহা হো হো করে হেসে ফেললেন। নিকি বলল,
কেন, পৃথিবীটাকে কি সরান যায় না?
নিশ্চয়ই যায়। তুমি যদি মঙ্গল গ্রহটা পরম পারমাণবিক বিস্ফোরণের সাহায্যে গুড়িয়ে দাও, তাহলেই সৌরমন্ডলে মধ্যাকর্ষণজনিত সমতা ব্যাহত হবে। এবং পৃথিবী ছিটকে সরে যাবে।
তা হলেই তো হয়। পৃথিবীকে নিরাপদ জায়গায় এই করে সরিয়ে নিলেই হয়।
কিন্তু একটা গ্রহ উড়িয়ে দিলে যে প্রচন্ড বিস্ফোরণ হবে তাতে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাবে। আর পৃথিবীকে অল্প একটু সরালেই তো জীবনধারণ একেবারেই অসম্ভব হয়ে উঠবে। ধর, পৃথিবী যদি সূর্যের একটু কাছে এগিয়ে আসে, তাহলেই উত্তাপে সুমেরু-কুমেরুর যাবতীয় বরফ গলে মহাপ্লাবন। আর সূর্য থেকে একটু দূরে সরে গেলে শীতে আমাদের শরীরের প্রোটোপ্লাজম পর্যন্ত জমে যাবে। বুঝলে?
নিকির চেহারা দেখে মনে হল সে ভীষণ। হতাশ হয়েছে। ফিহা চুপচাপ চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। অনিদ্রাজনিত ক্লান্তি এখন আর তার নেই! নিকির সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি নিজেও একটু উৎসাহিত হয়ে পড়েছেন। নিকির দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন,
আমি অবাক হয়ে লক্ষ করছি, প্রতিটি মেয়ে পৃথিবী রক্ষার জন্যে একএকটি পরিকল্পনা বের করে ফেলেছে। ট্রেনে আসবার পথে একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা, সেও নাকি কী বই পেয়েছে কুড়িয়ে পাঁচ হাজার বছরের পুরনো বই–তাতেও নাকি পৃথিবী কী করে রক্ষা করা যায় তা লেখা আছে। হা-হা-হা।
নিকি চুপ করে রইল। বেচারী বেশ লজ্জা পেয়েছে। লাল হয়ে উঠেছে চোখমুখ। ফিহা বললেন, নিকি, তুমি কি আমার কথায় লজ্জা পেয়েছে?
না।
এতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে যে, তোমরা সবাই কিছু-না-কিছু ভাবছ। আমার ভেতর কোনো রকম ভাবালুত নেই। তবু তোমাদের এসব কান্ডকারখানা দেখে মনে হয়, যে পৃথিবীর জন্যে সবার এত ভালোবাসা–তা নষ্ট হয় কী করে!