হাসি থামলে কাতর গলায় বললাম, আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। দয়া করে। আমায় আমার ঘরটি দেখিয়ে দেবেন? আমার কিছুই ভালো লাগছে না।
তিনি পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। অবসান ভাবে হাঁটছি। কী হতে যাচ্ছে কে জানে। আবছা আলোয় রহস্যময় লম্বা করিডোর। দুই পাশের প্রকান্ড সব কামরা বিচিত্র সব যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। অথচ এদের কোনো কিছুর সঙ্গে আমার কোনো যোগ নেই। আমি আমার জায়গায় ফিরে যেতে চাই, যেখানে আমার স্ত্রী আছে, আমার দুটি অবোধ শিশু আছে–দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে সঙ্গে অবোধ ভালোবাসা আছে।
পরবর্তী দু দিন, অনুমানে বলছি–সেখানে পৃথিবীর মতো দিন-রাত্রি নেই, আমার ওপর বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা হল। একেক বার একেকটি ঘরে ঢুকি। বিকট সব যন্ত্রপাতি আমার চারপাশে বসান হয়। তারপর ক্লাস্তিকর প্রতীক্ষ্ণ। একটি পরীক্ষা শেষ না হতেই অন্যটি শুরু। বিশ্রাম নেই, নিঃশ্বাস ফেলার অবসর টুকু নেই। আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করি না। কী হবে প্রশ্ন করে? নিজেকে ছেড়ে দিয়েছি ভাগ্যের হাতে! ক্লান্তিতে যখন মরমর হয়েছি, তখন বলা হল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন চৰ্বিশ ঘণ্টা পূৰ্ণ বিশ্রাম। তারপর আমাকে পাঠান হবে পৃথিবীতে।
সমস্ত দিন ঘুমালাম। ঘুম ভাঙলি দরজায় মৃদু টোকার শব্দ শুনে। গণিত বিভাগের একটি ছেলে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। কিছু বলবে, খুব জরুরি। রোগামতো লোকটি খুব নিচু গলায় বলল কথাগুলি।
আমি বললাম, কে সে?
নিনাষ। আপনি আসুন আমার সঙ্গে।
আমি নীরবে তাকে অনুসরণ করলাম। আমার মনে হল কিছু একটা হয়েছে, থমথমে ধর্মছে চারদিক। আনার মতো মেয়েটিও নেই কোথাও।
সবাই যেন অপেক্ষা করছিল আমার জন্যে। আমি যেতেই উৎসুক হয়ে নড়েচড়ে বসল। সবাই। তুমি আমার সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছিলে?
নিনাষ বলল, হ্যাঁ। আপনি জানেন কি, টাইফা গ্রহ অদৃশ্য হয়েছে?
আমি কিছুই জানি না।
তাহলে আমার কাছ থেকে জানুন। অল্প কিছুক্ষণ হল সমস্ত গ্রহটি চতুর্মাত্রিক গ্রহে পরিণত করা হয়েছে। কেমন করে জানলাম? ত্রিমাত্ৰিক গ্রহকে চতুমৰ্হত্রিক গ্রহে পরিণত করার নির্দিষ্ট হিসোব আমরা করেছি। আমরা সব জানি। শুধু যে টাইফা গ্রহই অদৃশ্য হয়েছে তাই নয়, একটি বৃত্তাকার স্থান ক্রমশই চতুর্মাত্রিক জগতে প্রবেশ করছে এবং আপনার পৃথিবী সেই বৃত্তের ভিতরে। বুঝলেন?
আমি বললাম, আমার তাহলে আর প্রয়োজন নেই?
এই মুহুর্তে আপনাকেই তাদের প্রয়োজন। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই চুপ করে বসে নেই। নিশ্চয় তারা এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে চেষ্টা করবে।–ফিহার মতো বিজ্ঞানী যেখানে আছেন। আমি খুব ভালো করে জানি, মহাজ্ঞানী ফিহা একটা বুদ্ধি বের করবেনই। যাক, ওসব ছেড়ে দিন। আপনাকে কী জন্যে পাঠান হবে জানেন?
না।
আপনাকে পাঠান হবে, যেন ফিহা পৃথিবী রক্ষার কোনো পরিকল্পনা করতে না পারেন, তাই দেখতে। ফিহার যাবতীয় কাগজপত্র আপনাকে নষ্ট করে ফেলতে বলবে। এমন কি প্রয়োজন হলে আপনাকে বলবে ফিহাকে হত্যা করতে। কিন্তু শুনুন, তা করতে যাবেন না। বুঝতে পারলেন? টাইফা গ্রহ চলে গেছে–পৃথিবী যেন না যায়।
ঘর থেকে বেরিয়েই দেখি আনা হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। আমাকে বলল,
সুসংবাদ। তুমি অল্প কিছুক্ষণের ভিতর পৃথিবীতে যাবে। তোমাকে কী করতে হবে তা মিহি বুঝিয়ে বলবেন।
আনা, চতুর্মাত্রিক জীবরা যখন তোমার মতো মানুষ তৈরি করতে পারে, তখন ওদের পাঠালেই পারত। পৃথিবীতে, ওরাই করতে পারত যা করার।
তৈরি মানুষ শক্তিবিলয় ভেদ করতে পারে না।
কিন্তু আনা, তোমরা আমাকে যা করতে বলবে তা আমি করব না।
নিনাষ কিছু বলেছে তোমাকে, না? ঠিক সে জন্যে নয়।
আমার মন বলছে আমি যা করব তা অন্যায়।
বাজে কথা রাখ–তুমি করবেই।
আমি করবই? যদি না করি?
না করলে ফিরে যেতে পারবে না তোমার স্ত্রী-পুত্রের কাছে খুব সহজ সত্য। তুমি কি তোমার ছেলেমেয়ের কাছে ফিরে যেতে চাও না?
চাই।
তা ছাড়া আরেকটা দিক ভেবে দেখ! তোমার তো কিছু হচ্ছে না। তুমি তোমার কাজ শেষ করে পৃথিবীতে নিজের ছেলেমেয়ের কাছে ফিরে যাবে। তারও পাঁচ হাজার বছর পর পৃথিবীর পরিবর্তন হবে। তার আগে নয়। এস, মিহির কাছে যাই, তিনি তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবেন। ও কি, তুমি কাঁদছ নাকি?
না, আমি ঠিক আছি।
বইটি অর্ধসমাপ্ত
বইটি অর্ধসমাপ্ত। এরপর আর কিছু নেই। উত্তেজনায় মাথুর হাঁপাতে লাগলেন। সেই মেয়েটি কোথায়, যে তাকে এই বইটি দিয়ে গেছে? তার সঙ্গে এই মুহুর্তে কথা বলা প্রয়োজন। মাথুর ঘরের বাতি নিভিয়েই বেরিয়ে এলেন। বাইরে ভোরের আলো ফুটেছে। ঘুমন্ত সিরান-পল্লীর ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছে নির্জন পথ। মাথুরের অল্প শীত করছিল। মেয়েটি কোথায় আছে তা তিনি জানেন। দরজায় টোকা দিতেই লী বলল,
কে?
আমি। আমি মাথুর।
লী দরজা খুলে দিল। মাথুর খুব ঠান্ডা গলায় বললেন,
বইটির শেষ অংশ কোথায়?
শেষ অংশ আমি পাই নি। আমি তনুতন করে খুঁজেছি।
মাথুর ধীরে ধীরে বললেন, লোকটি তার অভিজ্ঞতার কথা লিখে যেতে পেরেছে। তার মানেই হল সে ফিরে এসেছে নিজের জায়গায়। অর্থাৎ তার উপর যে দায়িত্ব ছিল তা সে পালন করেছে। সহজ কথায় ফিহাকে পৃথিবী রক্ষার কোনো পরিকল্পনা করতে দেয় নি। ফিহাকে আমাদের বড্ডো প্রয়োজন।
মাথুর আপন মনে বিড়বিড় করে উঠলেন, এক সময় নিঃশব্দে উঠে এলেন।