নিশ্চয়ই।
আপনাদের এ গ্রহের নাম?
টাইফা।
আমি লক্ষ করলাম, ঘরের নীল আলো কখন চলে গেছে। সবুজাভ আলোয় ঘর ভরে গেছে। আমি বললাম, শুনুন, আমি এবার সবুজ আলো দেখছি।
বলবার সঙ্গে সঙ্গে একটি অংশ নিঃশব্দে ফাকি হয়ে যেতে লাগল। আমি দেখলাম অসংখ্য কৌতূহলী মানুষ অপেক্ষা করছে বাইরে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি সেই গ্রহ থেকে এসেছি, যেখান থেকে তাদের পূর্বপুরুষ একদিন রওয়ানা হয়েছিল। অজানা সেই গ্রহের জন্যে সমস্ত ভালোবাসা এখন হাত বাড়িয়েছে আমার দিকে।
যাঁরা আমার চার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা প্রত্যেকেই বেশ বয়স্ক। একটু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম দীর্ঘ পাঁচ হাজার বৎসর একটি সম্পূৰ্ণ ভিন্ন গ্রহে কাটিয়ে মানুষের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয় নি। সাধারণ মানুষের চেয়ে শুধু একটু লম্বা, চেহারা একটু সবুজাভা–এই পরিবর্তনটাই চট করে চোখে পড়ে। চোখগুলি অবশ্য খুব উজ্জ্বল। মনে হয়। অন্ধকারে বেড়ালের চোখের মতো আলো ছড়াবে।
আমার নাম ক্রিকি। বলেই তাদের একজন আমার ঘাড়ে হাত রাখলেন। অল্প হেসে বললেন, আপনি আমাদের কথা ঠিক বুঝতে পারছেন তো?
আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। লম্বাটে ধরনের মুখ, ঢেউ খেলান লম্বা চুল। মুখভর্তি দাড়ি গোঁফে একটা জজ্বলে চেহারা। আমি বললাম, খুব ভালো বুঝতে পারছি। আপনারা কি এই ভাষাতেই কথা বলেন?
না, আমরা আমাদের ভাষাতেই কথা বলছি। আমাদের সবার সঙ্গেই অনুবাদক যন্ত্র আছে। আসুন, আমার নিজের ঘরে আসুন।
আমার খুব ইচ্ছে করছিল, বাইরে ঘুরে ঘুরে সব দেখি। এখানকার আকাশ কী রকম? গাছপালাই—বা কেমন দেখতে। প্রথম দিকে আমার যে নিস্পৃহ ভাব ছিল এখন আর সেটি নেই। আমি তীব্র উত্তেজনা অনুভব করছিলাম, যা-ই দেখছি তাই আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করছে। ক্রিকি বললেন, আমাদের এই গবেষণাগারে চারটি ভাগ আছে। সবচেয়ে জটিল এবং সবচেয়ে জরুরী বিভাগ হচ্ছে সময় পরিভ্রমণ বিভাগ। জটিলতম কারিগরি বিদ্যা কাজে খাটান হয়েছে। এখান থেকেই সময়ের অনুকূলে ও প্রতিকূলে যাত্রা করান হয়। যেমন আপনি এলেন। তার পরই আছে। অনঅধীত গণিত বিভাগ। দুরকম গণিত আছে, একটি হচ্ছে ব্যবহারিক, অন্যটি অনঅধীত–অর্থাৎ যে গণিত এখনো কোনো কাজে খাটান যাচ্ছে না। আমাদের এখানকার গণিত বিভাগটি হচ্ছে অনঅধীত গণিত বিভাগ।
তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগটি কি?
তৃতীয়টি হচ্ছে পদার্থবিদ্যা বিভাগ, চতুর্থটি প্রতি-পদার্থ১৮ বিভাগ। এ দুটির কাজ হচ্ছে অনঅধীত গণিতকে ব্যবহারিক গণিতে পরিণত করা। আসুন আমি আপনাকে সব ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি। আপনি ক্লান্ত নন তো?
না না, আমি ঠিক আছি। আমার সব দেখেশুনে বেড়াতে খুব ভালো লাগছে! প্রথমে আপনাকে নিয়ে যাব গণিত বিভাগে। অবশ্য সেটি আপনার ভালো লাগবে না।
গণিত বিভাগ দেখে আমি সত্যিই হকচকিয়ে গেলাম। হাসপাতালের লম্বা ঘরের মতো মস্তে লম্বা ঘর। রুগীদের যেমন সারি সারি বিছানা থাকে, তেমনি দুধারে বিছানা পাতা। তাদের মধ্যে অদ্ভুত সর বিকৃত শরীর শুয়ে আছে। সবারই বয়স পনের থেকে কুড়ির ভিতরে। আমাদের দেখতে পেয়ে তারা নড়েচড়ে বসল।
ক্রিকি বললেন, আপনি যে কয়দিন এখানে থাকবেন, সে কয়দিন আপনাকে গণিত বিভাগেই থাকতে হবে। গণিত বিভাগের প্রধান–যিনি এই গবেষণাগারের মহা পরিচালক, তার তাই ইচ্ছে।
আমি ক্রিকির কথায় কান না দিয়ে বললাম, এরা কারা? প্রশ্ন শুনে ক্রিকি যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। অবশ্যি আমি তখন খুব অবাক হয়ে সারবন্দী পড়ে থাকা এই সব অসুস্থ ছেলেদের দিকে তাকিয়ে আছি। কারো হাত-পা শুকিয়ে সুতার মতো হয়ে গিয়েছে, কারো চোখ নেই, কেউ ধনুকের মতো বেঁকে পড়ে আছে। কারো শরীরে আবার দিগদগে ঘা। আমি আবার বললাম, এরা কারা বললেন না?
ক্রিকি থেমে থেমে বললেন, এরা গণিতবিদ। টাইফা গ্রহের গণিতের যে জয়জয়কার, তা এদের জন্যেই। কথা শেষ না হতেই শুয়ে-থাকা অন্ধ একটি ছেলে চেঁচিয়ে বলল, টাইফা গ্রহের উন্নত গণিতের মুখে আমি থুতু দিই। বলেই সে খুঃ করে একদলা থুতু ফেলল। ক্রিকি বললেন, এই ছেলেটার নাম নিনাষ। মহা প্রতিভাবান।
আমি বললাম, এরা এমন পঙ্গু কেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
ক্রিকি বললেন, মায়ের পেটে থাকাকালীন এদের জীনে ১৯ কিছু অদলবদল করা হয়েছে। যার ফলে মস্তিকের একটি বিশেষ অংশের বিশ্লেষণী ক্ষমতা হাজার গুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু ওরা ঠিক মানবশিশু হয়ে গড়ে ওঠে নি। সুতীব্র গামা রশ্মির রেডিয়েশনের ফলে যে সমস্ত জ্বীন শরীরের অন্য অংশ নিয়ন্ত্রণ করত, তা প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলস্বরূপ এই বিকলাঙ্গতা। বিজ্ঞান সব সময়ই কিছু পরিমাণে নিষ্ঠুর।
এরা কি জন্ম থেকেই অঙ্কবিদ?
না। বিশিষ্ট অঙ্কবিদরা এদের বেশ কিছুদিন ভুঙ্ক শেখান।
কিন্তু এ তো ভীষণ অন্যায়।
ক্রিকি বললেন, না, অন্যায় নয়। শারীরিক অসুবিধে ছাড়া এদের তো অন্য কোনো অসুবিধে নেই। তাছাড়া এরা মহা সম্মানিত। বৃহত্তর স্বার্থের জন্যে সব সময় কিছু ব্যক্তিগত ত্যাগের প্রয়োজন।
এ রকম কত জন আছে?
আছে বেশ কিছু। কারো কারো কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে গিযেছে। কেউ কেউ এখনো শিখছে।
কত দিন কর্মক্ষমতা থাকে?
পাঁচ থেকে ছবছর। অত্যধিক পরিশ্রমে এদের মস্তিষ্কের নিওরোন নষ্ট হয়ে যায়।।
তাদের দিয়ে কী করা হয় তখন?
সেটা নাই-বা শুনলেন।
কিন্তু আমি এদের সম্বন্ধে জানতে চাই। দয়া করে বলুন। বৎসরে কত জন এমন বিকলাঙ্গ শিশু আপনারা তৈরি করেন?