এদের জন্ম-মৃত্যু আছে?
শক্তি তো সব সময় অবিনশ্বর নয়। এরও বিনাশ আছে। তবে আমি ঠিক জানি না কী হয়।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা কী রকম হয়?
কী রকম হয় বলতে পারব না, তবে তারা দ্রুত সৃষ্টির মূল রহস্যের দিকে এগিয়ে চলেছে।
একদিন আনা বলল, আজ তোমাকে ত্রিমাত্রিক গ্রহে নিয়ে যাওয়া হবে।
আমি বললাম, সেখানে আমি নিঃশ্বাস ফেলতে পারব তো? আনা হো হো করে হেসে বলল, নিশ্চয়ই। সেটি তোমার নিজের গ্রহ বলতে পোর। তোমার জন্মের প্রায় দু হাজার বৎসর পর পৃথিবীর মানুষের একটা ছোট্ট দল এখানে এসেছিল। তারপর আরো তিন হাজার বৎসর পার হয়েছে। মানুষেরা চমৎকার বসতি স্থাপন করেছে সেখানে। ভারি সুন্দর জায়গা।
আমার জন্মের পাঁচ হাজার বৎসর পরের মানুষদের কাছে আমি কী করে যাব?
তুমি ভুলে যাচ্ছ যে তুমি চতুর্মাত্রিক জগতে আছ। এখানে ত্ৰিশ হাজার বৎসর আগেও যা, ত্ৰিশ হাজার বৎসর পরেও তা।
তার মানে আমার বয়স কখনো বাড়বে না?
নিশ্চয়ই বাড়বে। শরীরবৃত্তির নিয়মে তুমি বুড়ো হবে।
কিন্তু ভবিষ্যতে যাওয়ার ব্যাপারটা কেমন?
তুমি কি একটি সহজ সত্য জান? কী সত্য? তুমি কি জান যে, কোনো যন্ত্রযানের গতি যদি আলোর গতির চেয়ে বেশি হয়, তবে সেই যন্ত্রযানে করে ভবিষ্যতে পাড়ি দেয়া যায়?
শুনেছি কিছুটা।
চতুর্মাত্রিক জগৎ একটা প্রচন্ড গতির জগৎ। সে গতি আলোর গতির চার গুণ বেশি। সে গতি হচ্ছে ঘৃণায়মান গতি। তুমি নিজে চতুর্মাত্রিক জগতে আছে। কাজেই অবিশ্বাস্য গতিতে ঘুরছ। যে গতি অনায়াসে সময়কে অতিক্রম করে।
কিন্তু আমি যতদূর জানি–কোনো বস্তুর গতি যখন আলোর গতির কাছাকাছি আসে, তখন তার ভর অসীম হয়ে যায়।
তা হয়।
তাহলে তুমি বলতে চাও আমার ভর এখন অসীম?
না। কারণ তুমি বস্তু নও, তুমি এখন শক্তি।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
তাতে বিশেষ কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। তুমি তৈরি হয়ে থাক। তোমাকে নিয়ে ত্ৰিমাত্রিক জগতে যাব এবং তার পরই তোমার কাজ শেষ।
ভিতরে ভিতরে আমি তীব্র কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলাম। কী করে কী হচ্ছে? আমাকে দিয়ে শেষ পর্যন্ত কী করা হবে, এতা জানার জন্যে আমি প্ৰায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিলাম। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, এত উদ্যোগ আয়োজন নিশ্চয়ই কোনো একটি অশুভ শক্তির জন্যে।
দাঁতের ডাক্তারের কাছে দাঁত তুলতে গেলে যেমন বুক-কোপান আতঙ্ক নিয়ে বসে থাকতে হয়, বিভিন্ন গ্রহে যাবার জন্যে আমি তেমনি আতঙ্ক নিয়ে প্রতীক্ষ্ণ করতে লাগলাম।
যদিও অন্য একটি গ্রহে যাবার কথা ভেবে আতঙ্কে আমার রক্ত জমে যাচ্ছিল, তবু যাত্ৰাটা কী করে হয়, তা জানার জন্যে প্রচন্ড কৌতূহলও অনুভব করছিলাম। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটি এত হঠাৎ করে হল যে, আমি ঠিক কী যে হচ্ছে তাই বুঝতে পারলাম না।
দেখলাম চোখের সামনে থেকে আচমকা পরিচিত ঘরটি অদৃশ্য হয়েছে। চারিদিকে চোখ-ধাঁধান হলুদ আলো–যার কথা আমি আগেও অনেক বার বলেছি। মাথার ভিতরে তীক্ষ্ণ তীব্র যন্ত্রণা। যেন কেউ সূক্ষ্ম তলোয়ার দিয়ে সাঁই করে মাথাটি দু, ফাঁক করে ফেলেছে। ঘুরঘুর করে উঠল পেটের ভিতর পা ও হাতের পাতাগুলি জ্বালা করতে লাগল। আগেই বলেছি সমস্ত ব্যাপারটি খুব অল্প সময়ের ভিতর ঘটে গেল। সমস্ত অনুভূতি উল্টেপান্টে যাবার আগেই দেখি চৌকোণা একটি ঘরে আমি দাঁড়িয়ে আছি। একা, মেয়েটি পাশে নেই। যেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি, তার চারপাশে অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি। চকচকে ঘড়ির ডায়ালের মতো অজস্র ডায়াল। কোনোটির কাটা স্থির হয়ে আছে। বড় বড়। লিভার জাতীয় কিছু যন্ত্র। গঠনভঙ্গি দেখে মনে হয়। হাত দিয়ে চাপ দেবার জন্যে তৈরি। টাইপ রাইটারের কী-বোর্ডের মতো বোতামের রাশ। প্রতিটিতেই হালকা আলো জ্বলছে। মাথার ঠিক উপরে সা সাঁ করে পাখা ঘুরছে। পাখাটির আকৃতিও অদ্ভূত। ফুলের কুড়ি ফুটে উঠছে, আবার বুজে যাচ্ছে–এই রকম মনে হয়। কোনো বাতাস আসছে না। সেখান থেকে। পিপি। করে একটা তীক্ষ্ণ আওয়াজ হচ্ছে কেবল। হঠাৎ পরিষ্কার শুনলাম, দয়া করে অল্প কিছু সময় অপেক্ষা করুন। বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলুন। আলোর বেগে এসেছেন। আপনি এখানে। আপনার শরীরের প্রতিটি অণু থেকে গামা রশ্মি১৭ বিকিরণ হচ্ছে, আমরা এটি বন্ধ করছি। কিছুক্ষণের ভিতরেই আপনি আসবেন আমাদের মধ্যে। আপনি আমাদের সম্মানিত অতিথি।
আমি চুপ করে কথাগুলি শুনলাম। যেভাবে বলা হল সেভাবেই নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলাম। আবার তাদের গলা শোনা গেল, আপনি দয়া করে আমাদের কতগুলি প্রশ্নের জবাব দিন।
আমি বললাম, প্রশ্ন করুন, আমি জবাব দিচ্ছি।
আপনার কি ঘুম পাচ্ছে?
না।
আপনার কি মাথা ধরেছে?
কিছুক্ষণ আগে ধরেছিল, এখন নেই।
মুগা বলুন তো ঘরে কী রঙের আলো জ্বলছে?
নীল।
ভালো করে বলুন, সবুজ নয় তো?
না, সবুজ নয়।
হালকা নীল?
না, ঘন নীল। আমাদের পৃথিবীর মেঘশূন্য আকাশের মতো। উত্তর শুনে প্রশ্নকতা একটু যেন হকচাকিয়ে গেলেন। কারণ পরবর্তী কিছুক্ষণ আর কোনো প্রশ্ন 6siन्मा 65छ না!
আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রশ্নকতা এবার থেমে থেমে বললেন, আপনি কি জানেন, আমাদের পূর্বপুরুষ একদিন পৃথিবী থেকেই এ গ্রহে এসেছিলেন?
আমি জানি।
আপনি আমাদের একান্ত আপন জন। আপনি এখানে এসেছেন, সেই উপলক্ষে আজ আমাদের জাতীয় ছুটির দিন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কী আশ্চর্য আপনারা জানতেন আমি এসেছি?