কাদের সঙ্গে কথা বলব?
যারা তোমাকে নিয়ে এসেছে।
যারা আমাকে নিয়ে এসেছে তারা কেমন? তারা কি মানুষের মতো?
তাদের তুমি দেখতে পাবে না। এরা চতুর্মাত্রিক জীব। পৃথিবীর মানুষ ত্রিমাত্রিক জিনিসই শুধু দেখতে পায় ও অনুভব করস্কে পারে। সেগুলি তাদের ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য। চতুমৰ্হত্রিক জগৎ তোমাদের কাছে ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য হবে না।
শুনতে শুনতে আমার গা ছমছম করতে লাগল। এসব কী বলছে সে! ভয় পেয়ে আমি মেয়েটির হাত ধরলাম। এই অদ্ভুত তৈরি পরিবেশে তাকেই আমার একান্ত আপন জন মনে হল। মেয়েটি বলল, আমাকে তুমি আনা বলেই ভাববে। আপনার সঙ্গে যেভাবে আলাপ করতে, সেইভাবেই আলাপ করবে। আমাকে ভয় পেয়ো দিন। তোমার যা জানতে ইচ্ছে হবে। আমার কাছ থেকে জেনে নেবে। আমি তো তোমাকে বলেছি, আবার তুমি ফিরে যাবে তোমার সত্যিকার আনার কাছে।
আমি বললাম, এই যে আমি আমার ঘরে শুয়ে আছি, নিজের বইপত্র টেবিলে পড়ে আছে, এসবও কি আমার মতো পৃথিবী থেকে আনা হয়েছে?
এইগুলি আনতে হয় নি। তৈরি করা হয়েছে। ইলেকটন, প্রোটন এই সব জিনিস দিয়ে তৈরি হয় এটম। বিভিন্ন এটমের বিভিন্ন অনুপাতে তৈরি হয় এক একটি বস্তু। ঠিক তো?
হ্যাঁ, ঠিক।
কোনো বস্তুর প্রতিটি ইলেকট্রন, প্রোটন কী অবস্থায় আছে এবং এটমগুলি কীভাবে আছে, সেগুলি যদি জানা থাকে এবং ঠিক সেই অনুপাতে যদি ইলেকট্রন, প্রোটন এবং এটম রাখা যায়। তবেই সেই বস্তুটি তৈরি হবে। ঠিক তো?
হয়তো ঠিক।
কিছু শক্তি খরচ করলেই হল। এইভাবেই তোমার ঘর তৈরি হয়েছে। আমিও তৈরি হয়েছি। এখানকার জীবরা মহাশক্তিধর। এই হচ্ছে তোমার প্রথম পাঠ। হ্যাঁ, এবার চা খাও। দাও, চায়ে চুমুক দাও।
আমি চায়ে চুমুক দিলাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি আনা অল্প অল্প হাসছে। আমার সে মুহূর্তে এই মেয়েটিকে সত্যি সত্যি আনা বলেই ভাবতে ইচ্ছে হল।
আমার নিজের অনুভূতি কখনো খুব একটা চড়া সুরে বাধা ছিল না। সহজ স্বাভাবিক জীবনযাপন করে এসেছি। হঠাৎ করেই যেন সব বদলে গেল। নিজেকে যদিও ঘটনাপ্রবাহের উপর সম্পূৰ্ণ সঁপে দিয়েছিলাম, তবু একটা ক্ষীণ আশা সব সময় লালন করেছি।–হয়তো এক সময় দেখব। আশেপাশে যা ঘটছে। সমস্তই মায়া, হয়তো একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি। এক্ষুণি স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠব। মেয়েটি বলল, কী তাবিছ?
কিছু ভাবছি না। আচ্ছা একটা কথা—
বল।
কী করে এসেছি আমি এখানে?
সেই জটিল প্রক্রিয়া বোঝবার উপায় নেই।
এটা কেমন জায়গা?
কেমন জায়গা তা তোমাকে কী করে বোঝাব? তুমি ত্রিমাত্রিক জগতের লোক, আর এটি হচ্ছে চতুর্মাত্রিক জগৎ।
কিছুই দেখা যাবে না?
চেষ্টা করে দেখা যাও, বাইরে পা দাও। দরজাটা আগে খোল। কী দেখছ?
আমার সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠল। চারিদিকে ঘন ঘোলাটে হলুদ আলো। পেটের ভেতরে চিনচিনে ব্যথা। মাথা ঘুরতে লাগল আমার।
থাক আর দেখবার কাজ নেই, এসে পড়া।
আমার মনে হল মেয়েটি যেন হাসছে আপন মনে। আমি চুপ করে রইলাম। মেয়েটি বলল, তুমি অল্প কিছুদিন থাকবে এখানে। তারপর তোমাকে পাঠান হবে একটা ত্রিমাত্রিক জগতে, সেখানে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।
আমি বললাম, তুমি থাকবে তো সঙ্গে?
নিশ্চয়ই। আমি তোমার এক জন শিক্ষক।
আচ্ছা একটা কথা–
বল।
এখানকার জীবদের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ কী করে হয়?
আমি জানি না।
তাদের সম্বন্ধে কিছুই জানি না?
না।
তাদের সঙ্গে তোমার কথা হয় না?
না।
আমার সঙ্গে যে আলাপ আলোচনা হবে তা তাদের কী করে জানাবো?
তাদের জানাতে হবে না। আমি কি নিজের থেকে কিছু বলি তোমাকে? যা বলি সমস্তই ওদের কথা। চুপ করে আছ কেন? তোমাকে তো আগেই বলেছি, তুমি তোমার নিজের জায়গায় ফিরে যাবে।
তোমাকে ধন্যবাদ।
দিন-রাত্রির কোনো তফাৎ ছিল না বলেই আমি ঠিক বলতে পারব না, কদিন সেই ছোট্ট ঘরটিতে ছিলাম। ক্ষুধা—তৃষ্ণা আগের মতোই হয়। নিজের বাসায় যে ধরনের খাবার খাওয়া হত, সেই ধরনের খাবারই দেওয়া হয় এখানে, আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী হল সেই মেয়েটি, যে দেখতে অবিকল আনার মতো, অথচ আনা নয়। খুবই আশ্চর্যের কথা, মেয়েটির সঙ্গে আমার ভারি ঘনিষ্ঠতা হল। মাঝে মাঝে আমার প্রচন্ড ভ্রম হত এ হয়তো সত্যি আনা। সে এমন অনেক কিছুই বলতে পারত, যা আনা ছাড়া অন্য কারো বলা সম্ভব নয়। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এসব কী করে জানলে?
মেয়েটি হেসে বলেছে, যে সমস্ত স্মৃতি আনার মেমরি সেলে আছে, সে সমস্ত স্মৃতি আমার ভেতরেও তৈরি করা হয়েছে। আনার অনেক কিছুই মনে নেই, কিন্তু আমার আছে।
আমি এসব কিছুই মেলাতে পারছিলাম না। এ কেমন করে হয়! একদিন নখ দিয়ে আচড়ে দিলাম মেয়েটির গালে, সত্যি সত্যি রক্ত বেরোয় কিনা দেখতে। সত্যিই রক্ত বেরিয়ে এল। সে অবাক হয়ে বলল, এসব কী ছেলেমানুষি কর?
দেখি, তুমি সত্যি মানুষ না অন্য কিছু।
এর ভেতর আমি অনেক কিছু শিখলাম। অনেক কিছুই বুঝতে পারি নি। আনার আন্তরিক চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। কিন্তু বিজ্ঞান এমনিতেই আমি কম বুঝি। চতুর্মাত্রিক সম্বন্ধে নিম্নলিখিত কথাবাত হল।
চতুর্মাত্রিক জীবরা কি কোনো খাদ্য গ্রহণ করে?
না, করে না।
এরা কেমন? অথাৎ ব্যাপারটি কী?
এরা হচ্ছে ছড়িয়ে থাকা শক্তির মতো? যেমন মনে কর এক গ্লাস পানি। পানির প্রতিটি অণু একই রকম। কোনো হেরফের নেই। সমস্ত অণু মিলিতভাবে তৈরি করেছে পানি। এরাও সে রকম। কারোর কোনো আলাদা অস্তিত্ব নেই। সম্মিলিতভাবেই তাদের পরিচয়। তাদের জ্ঞান সম্মিলিত জ্ঞান।