- বইয়ের নামঃ তাহারা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
নিউরোলজির অধ্যাপক আনিসুর রহমান খান
নিউরোলজির অধ্যাপক আনিসুর রহমান খান খুবই বিরক্ত হচ্ছেন। তাঁর ইচ্ছা করছে সামনে বসে থাকা বেকুবটার গালে শক্ত করে থার দিতে। বেকুবটা বসেছে তাঁর সামনে টেবিলের অন্য প্রান্তে। এত দূর পর্যন্ত হাত যাবে না। অবশ্যি তাঁর হাতে প্লাস্টিকের লম্বা স্কেল আছে। তিনি স্কেল দিয়ে বেকুবটার মাথায় ঠাস করে বাড়ি দিয়ে বলতে পারেন—যা ভাগ।
কী কী কারণে এই কাজটা তিনি করতে পারলেন না তা দ্রুত চিন্তা করলেন।
প্রথম কারণ বেকুবটা তার ছেলেকে নিয়ে এসেছে। ছেলের সামনে বাবার গালে থাপ্পর দেয়া যায় না বা স্কেল দিয়ে মাথায় বাড়ি দেয়া যায় না। থাপ্পর বাদ। এটা টেকনিক্যালি সম্ভব না। বাকি থাকল স্কেলের বাড়ি।
দ্বিতীয় কারণ বেকুবটা পাঁচশ টাকা ভিজিট দিয়ে তাঁর কাছে এসেছে। সরকারি নিয়মে প্রাইভেট প্যাকটিশনাররা তিনশ টাকার বেশি ভিজিট নিতে পারেন না। তিনি নেন—তারপরেও রোগী কমে না। যে পাঁচশ টাকা ভিজিট দিয়ে এসেছে তার মাথায় স্কেল দিয়ে বাড়ি দেয়া যায় না।
তৃতীয় কারণ স্কেলটা প্লাস্টিকের। তিনি গতবার জার্মানি থেকে এনেছেন। স্কেলটা তিন ফুট লম্বা। ফোল্ড করা যায়। মাথায় বাড়ি দিলে স্কেল ভেঙে যেতে পারে।
অধ্যাপক আনিসুর রহমান স্কেল হাতে নিয়ে কুঁচকে ভাবছেন এই তিনটি কারণের মধ্যে কোনটা জোরালো। বৈজ্ঞানিকভাবে বলা যেতে পারে ওয়েটেজ কত?
তিনি লক্ষ করলেন বেকুবটা পকেটে হাত দিয়ে একটা কার্ড বের করে তার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।
স্যার এইটা আমার কার্ড। আমার নাম জালাল। কাটা কাপড়ের ব্যবসা করি। বঙ্গ বাজারে আমার একটা দোকান আছে। আমার ভাইস্তা দোকান দ্যাখে আমি সময় পাই না। দোকানের নাম জালাল গার্মেন্টস।
আনিসুর রহমান হাতের স্কেল নামিয়ে রাখলেন। টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে নিজের নাক মুছে টিস্যু পেপার ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটের দিকে ছুড়ে মারলেন। বাস্কেটে পড়ল না। যখনই তিনি রোগী দেখেন এই কাজটা করেন। যখন ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে টিস্যু পড়ে না তখন তিনি ধরে নেন এই রোগীর চিকিৎসায় কোন ফল হবে না। যদিও এরকম মনে করার কোন কারণ নেই। কুসংস্কার, খারাপ ধরনের কুসংস্কার। বিজ্ঞানের মানুষ হয়ে এই কাজে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক না।
স্যার আমার দোকানে একবার যদি পদধূলি দেন তাহলে অত্যন্ত খুশি হব। আপনাদের মত অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বঙ্গ বাজারে যান।
আপনার নাম জালাল?
জি। আমার ভাইস্তার নাম রিয়াজ। ফিল্ম আর্টিস্ট রিয়াজ যে আছে তার সাথে চেহারার কিঞ্চিৎ মিলও আছে। তবে তার গায়ের রঙ রিয়াজ ভাইয়ের চেয়েও ভাল।
আপনি আপনার ছেলেকে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন?
জ্বি জনাব। আমার একটাই ছেলে তার নাম হারুন। ভাল নাম হারুন অর রশিদ। বাগদাদের খলিফার নামে নাম রেখেছি।
আপনি এত কথা বলছেন কেন জানতে পারি? রোগী দেখাতে এসেছেন রোগীর বিষয়ে কথা বলবেন। কী রোগ সেটা বলবেন। দুনিয়ার কথা শুরু করেছেন।
জনাব আমার গোস্তাকি হয়েছে। ক্ষমা করে দেবেন। কথা আগে আমি এত বলতাম না। কম বলতাম। স্ত্রীর মৃত্যুর পর কথা বলা বেড়ে গেছে। আগে পানও খেতাম না। স্ত্রীর মৃত্যুর পর পান খাওয়া ধরেছি—এখন সারাদিনই পান খাই। বললে বিশ্বাস করবেন না চা যখন খাই তখনো এক গালে পান থাকে।
আপনার ছেলের সমস্যা কী?
অংক সমস্যা।
অংক বুঝতে পারে না এই সমস্যা?
জ্বি না—এইটাই সে বুঝে। যে অংক দেবেন চোখের নিমিষে করবে। চোখের পাতি ফেলনের আগে অংক শেষ।
এটাতো কোন সমস্যা হতে পারে না।
খাঁটি কথা বলেছেন স্যার। এটা ভাল। তারে টেস্ট করার জন্য দূরদূরান্ত থেকে লোক আসে। একবার টেলিভিশন থেকে এসেছিল ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবে। নিয়ে গিয়েছিল। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানটা আপনি দেখেছেন কি না জানি না। অনেকেই দেখেছে। আমি নিজে দেখতে পারি নাই। বেছে বেছে অনুষ্ঠান চলার সময় কারেন্ট ছিল না। অনুষ্ঠানের শেষে ছিল একটা পুরানো দিনের গান—আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে, সাত সাগর আর তের নদীর পারে। ঐটা শুধু দেখেছি। সাগরিকা ছবির গান। সাগরিকা ছবিটাও দেখেছি। উত্তম সুচিত্রার ছবি।
জালাল সাহেব।
জ্বি।
আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে চলে যান। এই ছেলেকে আমার দেখার কিছু নাই। আমি নিউরোলজির কোন সমস্যা হলে দেখি।
পাঁচশ টাকা আমি আপনার এসিসটেন্টকে ভিজিট দিয়েছি।
ভিজিটের টাকা ফেরত নিয়ে যান আমি বলে দিচ্ছি। আনিসুর রহমান বেল টিপলেন।
জালাল কাতর গলায় বলল, জনাব সমস্যাটা একটু শুনেন। আমিতো সমস্যা বলতেই পারি নাই। বিরাট বিপদে আছি।
আমার নিজের শরীর ভাল না। আজ আমি আর রোগী দেখব না।
কাল আসি? কাল অবশ্য মাল নিয়ে আমার চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাওয়ার কথা। আমি নিজে মাল নিয়ে কখনো যাই না। ছেলে একলা থাকে। মা-মরা স্নেহ বঞ্চিত ছেলে। তার সঙ্গে থাকতে হয়। এই যে কাল যাচ্ছি ছেলেকেও সাথে নিয়ে যাচ্ছি। মালামাল নিয়ে যাওয়ার কাজের জন্যে আমার একজন কর্মচারী ছিল— ইরিস নাম। গত এপ্রিল মাসের নয় তারিখ এগারো হাজার টাকার মাল আর নগদ ছয় হাজার টাকা নিয়ে পালায়ে গেছে। থানায় জিডি এন্ট্রি করেছি।