নীম চোখ মিটমিট করে বলল, আজ হঠাৎ জিজ্ঞেস করছ কেন?
জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।
এখন আমি কিছু বলছি না। যখন সময় আসবে, তখন জানবে।
সময় কখন আসবে?
খুব শিগগিরই আসবে। লী, ঘরের রহস্য আমি বের করে ফেলব।
তুমি কি এই সব নিয়ে ভাব?
হ্যাঁ ভাবি। সব সময়ই ভাবি।
নতুন যে তথ্য পাওয়া গেছে, সেগুলি কি তুমি জান?
দ্বৈত সূর্য এবং ব্ল্যাক হোল? আমি জানি।
লী চুপ করে গেল। নীম মৃদু স্বরে বলল, আমি রহস্যের খুব কাছাকাছি আছি।
কি রকম কাছাকাছি?
যেমন ধর, এখন আমি নিশ্চিত জানি, আমরা ভিন্ন গ্রহের জীব–আমাদের এখানে এনে রাখা হয়েছে। এমন একটি গ্রহে এনে রাখা হয়েছে, যেখানে বসে বসে চিন্তা করা ছাড়া আর আমাদের কিছুই করার নেই।
তা ঠিক। আমিও তাই মনে করি।
নীম হঠাৎ গম্ভীর স্বরে বলল, লী।
বল।
তোমাকে আরেকটি ব্যাপার বলি–মন দিয়ে শোন। যদি কখনো আমাদের কাছে মনে হয় নিওলিথি সভ্যতা আমাদের পূর্বপুরুষদের তৈরি, তাহলে অবাক হয়ো না।
কী বলছ পাগলের মতো!
ঠাট্টা করছিলাম।
ঠাট্টা আবার কি?
মানুষদের কাছে শিখেছি। কোনো অবাস্তব ব্যাপার বিশ্বাসযোগ্যভাবে বলার নাম হচ্ছে ঠাট্টা। নিছক আনন্দের জন্যে করা হয়।
নীম মহানন্দে তার লুখ নাচাতে লাগল।
একটি লাল তারা
ক্যাপ্টেনের ঘরের সামনে একটি লাল তারা এবং দুটি সবুজ তারা জ্বলজ্বল করছে। যার মানে, অবস্থা যত জরুরিই হোক, তাকে বিরক্ত করা চলবে না। তবু স্রুরা তাঁর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সুইচ টিপল।
কে।
আমি স্রুরা।
লাল তারা এবং সবুজ তারা দুটি কি তোমার চোখে পড়ছে না?
পড়ছে। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।
গ্যালাক্সি-ওয়ানের নিয়ম ভঙ্গ করছ তুমি। ধারা ৩০১ উপাধারা ছয় অনুযায়ী কী শাস্তি তুবি পাবে তা জান?
জানি।
তবু তুমি যাবে না।
না। আপনি বলুন ঐ প্রাণী তিনটিকে আলাদা আলাদা সেলে কেন আটকিয়েছেন?
আমি আটকাই নি, ওরা আপনি গিয়েছে।
আপনার উদ্দেশ্য কী?
আমার একটি মাত্র উদ্দেশ্য মহাকাশযানটির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।
কিম দুয়েন।
বল।
আপনি আমাকে ভেতরে আসতে দেবেন না?
না। তোমার স্নায়ু উত্তেজিত, তোমাকে ভেতরে আসতে দেয়া ঠিক হবে না। এবং আমার মনে হচ্ছে, তুমি তোমার এটমিক ব্লাস্টারটি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ। শোন স্রুরা, তুমি একটি প্রথম শ্রেণীর অপরাধ করেছ। তোমার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তুমি চলে যাও এখান থেকে। আমি সমস্ত ব্যাপারটি ভুলে যাব।
স্রুরা ভাঙা গলায় বলল, স্যার, আপনি আমাকে দিয়ে এই কাজটি কেন করালেন? ক্যাপ্টেন শান্ত স্বরে বললেন, আমি ওদের সেলে যাওয়ার কথা বলতে পারতাম না। এরা মনের কথা বুঝতে পারে। তোমাকে পাঠানো হয়েছে সে জন্যেই। তোমার মধ্যে ওদের জন্য ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই নেই।
খেলা খুব জমে উঠেছে। নীম তার হাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সিডিসি বলল, সাবধান হয়ে খেল, তুমি ফাঁদে পা দিচ্ছ নীম।
তোমার ফাঁদ আমি কেয়ার করি না।
নীম তার হাতির ঠিক পিছনের ঘরে নৌকা টেনে আনল। সিডিসি বলল, এতে ভালো হবে না। আমি আমার ঘোড়া নিয়ে আসছি। নৌকা নিয়ে আক্রমণের সুযোগ পাবে না তুমি।
নীম চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রইল। সত্যি সত্যি সে আটকা পড়ে গেছে। এখন একমাত্র পথ, কালো হাতিটি নিচে নামিয়ে নেয়া। তাতে কী লাভ হবে। নীম কালো হাতিটি সরাল।
আর ঠিক তখন সুতীব্র ওমিক্রন রশ্মি ঝলসে উঠল। থার্মাল এক্সিলেটর কাঁপতে শুরু করল। নীম স্তম্ভিত হয়ে বলল, কী হচ্ছে এসব।
সিডিসি ধাতব স্বরে বলল, আমি চাল দিয়েছি। তুমি তোমার গজ সরাও নীম।
নীম অবাক হয়ে বলল, মানুষরা কি আমাদের মেরে ফেলতে চাচ্ছে?
সিডিসি বলল, তুমি দেরি করছ নীম।
আমার কথার জবাব দাও। তোমরা কি আমাদের মেরে ফেলতে চাচ্ছি?
হ্যাঁ।
নীম ব্যাকুল হয়ে ডাকল, লী! অয়ু!! কোথায় তোমরা? কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। আহ, কী অসহনীয় উত্তাপ।
সিডিসি বলল, দাও কী চাল দেবে?
নীম তার একটি ঘোড়া এগিয়ে আনল। সিডিসি উফুল স্বরে বলল, তুমি জিতে যাচ্ছ, বাহ্ চমৎকার! তুমি এই খেলাটিতে জিতে যাচ্ছ।
নীম ক্লান্ত স্বরে বলল, তুমি ইচ্ছা করে ভুল চাল দিয়ে আমাকে জিতিয়ে দিচ্ছ। তার প্রয়োজন নেই। আমি এভাবে জিততে চাই না।
বেশ, তাহলে আমি চালটি ফিরিয়ে নিই।
সিডিসি, আমি পারছি না। আমাকে এখন কোনো সমস্যা নিয়ে ভাবতে হবে। ব্যথা ভুলে থাকার অন্য পথ কিছু নেই।
নীমের শরীরের সিলিকন কোষ গলে যেতে শুরু করেছে। একটি অত্যন্ত জটিল সমস্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করা দরকার। কিন্তু কোনো সমস্যা মাথায় আসছে না। শুধু সুখ-কল্পনা আসছে। নীম যেন দেখতে পাচ্ছে, বহুকাল আগের তার হারানো মা ফিরে এসেছেন। কোমল কণ্ঠে বলছেন, এস আমার বাবারা, এস আমার সোনারা। কোথায় আমার দুঃখী লী, কোথায় আমার মানিক অয়ু? কোথায় আমার পাগলা নীম–?
নীম ফিসফিস করে বলল, মানুষের মতো বুদ্ধিমান প্রাণী এত হৃদয়হীন হয় কী করে? কম্পিউটার সিডিসি।
বল শুনছি।
আমি তোমাদের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমি নিওলিথি সভ্যতার রহস্য ভেদ করেছি। মরবার আগে মানুষের তা জানিয়ে যেতে চাই।
ওমিক্রন রশ্মি তীব্রতর হল। নিওলিথি রহস্যের কথা আর নীমের বলা হল না।
কম্পিউটার সিডিসি গ্যালাক্সি-ওয়ানের প্রতিটি কক্ষে নিওলিথি সভ্যতার অপূর্ব বিষাদমাখা সুর বাজাতে শুরু করেছে। ক্যাপ্টেন একাকী তাঁর ঘরে বসে ছিলেন। সুরের জন্যেই হোক বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছিল।