কথা খুবই ঠিক। ভেতরটা ছমছমান নীরবতা। ডঃ জুরাইন বললেন, শুধু যে সুরধ্বনি নেই তা নয়, আমাদের কথাবার্তার কোনো প্রতিধ্বনিও হচ্ছে না। এ রকম প্রকাণ্ড বন্ধ ঘরে প্রতিধ্বনি হওয়া উচিত।
স্যার, আরেকটি জিনিস লক্ষ করেছেন, আমাদের পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে? মনে হচ্ছে আমাদের ওজন অনেক বেশি।
হুঁ, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রায় 2G-এর কাছাকাছি।
স্যার, মানসিক ভারসাম্য হারাবার মতো আমি তো কিছুই দেখছি না। ভেতরটায় তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। তবে একটু ভয় ভয় করছে।
কী রকম ভয়। কিছু কুৎসিত প্রাণী হঠাৎ বেরিয়ে এসে আক্রমণ করবে, এই জাতীয়?
না স্যার, অন্য রকম ভয়।
দুজনে ঘরটির ঠিক মাঝামাঝি এসে দাঁড়াল। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জন্যে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। তার উপর মেঝেটি অসম্ভব পিচ্ছিল। ঘরের মাঝামাঝি একটি বৃত্তাকার দাগ দেখা গেল। দাগটি গাঢ় সবুজ রঙের এবং চাপা এক ধরনের আলো বের হচ্ছে।
বৃত্তের ভেতর এসে দাঁড়াতেই ডঃ জুরাইন প্ৰচণ্ড অস্থিরতা অনুভব করলেন। তাঁর মনে হল, আবছা অন্ধকার ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। ঘরময় হালকা নীলাভ আলো। সেই আলো বেড়ে যাচ্ছে। তিনি এক ধরনের কোলাহল শুনতে পেলেন। যে কোলাহল সমুদ্রগর্জনের মতো গম্ভীর ও বিলম্বিত। নিমায়ের উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, স্যার, আপনার কী হয়েছে, এরকম করছেন কেন?
ডঃ জুরাইনের সম্বিত ফিরে এল। তিনি দেখলেন, সব আগের মতোই আছে। কিছুই বদলায় নি। তিনি বললেন, শরীর ভালো লাগছে না। খুব সম্ভব আমার হেলুসিনেশন হচ্ছে।
আমার মনে হয় আপনার স্পেস-স্যুটের অক্সিজেন ভাব কাজ করছে না। অক্সিজেনের হঠাৎ অভাব হলে এ রকম হয়।
হতে পারে, হওয়া খুবই সম্ভব।
কথা শেষ হবার আগেই আবার তার আগের মতো হল। এবার মনে হল, আলোর তীব্রতা অসম্ভব বেশি। সমুদ্রগর্জনের মতো সেই শব্দও স্পষ্ট হল। ঝনঝন করে কানে বাজতে লাগল। নিমায়ের ডাকল, ডঃ জুরাইন, ডঃ জুরাইন। তিনি তার ডাক শুনতে পেলেন না। হঠাৎ তার মনে হল, তিনি অনেক কিছুই বুঝতে পারছেন। সৃষ্টিতত্ত্বের মূল রহস্য ক্রমে ক্রমেই তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে আসছে। এত দিন যা তিনি জেনে এসেছেন, তা মূ সত্যের আংশিক ছায়ামাত্রা। নিমায়ের তাঁকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে ডাকল, ডঃ জুরাইন, ডঃ জুরাইন।
কেউ সাড়া দিল না।
ক্যাপ্টেনের ঘর অন্ধকার
ক্যাপ্টেনের ঘর অন্ধকার।
তাঁর ঘরের বাইরে তারকাকৃতির দুটি লালবাতি জ্বলছে। যার মানে হচ্ছে, দ্বিতীয় শ্রেণীর জরুরি অবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে ডাকা যাবে না। ক্যাপ্টেন বিছানায় শুয়ে আছেন। তাঁর ঘুম আসছে না। স্নায়ু উত্তেজিত হয়েছে। ঘুম আসবার কথা নয়। অনেকগুলি বড় বড় ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে। কোনোটিরই কিনারা হচ্ছে না।
সন্ধানী স্কাউটশিপ থেকে এখনো কোনো খবর পাওয়া যায় নি। নিওলিথি ধ্বংসস্তূপের কাছাকাছি থাকলে খবর পাওয়া যাবে না তা ঠিক, কিন্তু এত দীর্ঘ সময় সেখানে তারা থাকবে কেন? দ্বিতীয় অনুসন্ধানী জাহাজ পাঠানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
এদিকে প্রাণী তিনটিকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। না পারার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। প্রাণীগুলি অসাধারণ বুদ্ধিমান। স্পষ্টতই বোঝ যাচ্ছে এই নির্জন মৃত গ্রহে তারা যে কোনোভাবেই হোক আটকা পড়েছিল। গ্যালাক্সি-ওয়ান হচ্ছে তাদের একমাত্র মুক্তির পথ। একটি বুদ্ধিমান প্রাণী নিজের মুক্তির জন্যে যতদূর সম্ভব নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করবে। প্রাণীর ধর্মই তাই। যে শ্ৰেষ্ঠ সে-ই টিকে থাকবে। এই সুবিশাল নক্ষত্রপুঞ্জ দুর্বলের জন্যে নয়। প্রাণীগুলি মানুষের তুলনায় উন্নত, এটি তিনি মানতে রাজি নন। তাদের মানসিক বুদ্ধিবৃত্তি উন্নত হতে পারে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে মানুষের সঙ্গে এদের তুলনা করা ঠিক হবে না। কিন্তু যদি ওরা সত্যিই মানুষের চেয়ে উন্নত হয়, তাহলে? সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
ক্যাপ্টেন চিন্তিত মুখে সুইচ টিপে সিডিসির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।
হ্যালো ক্যাপ্টেন।
হ্যালো।
ঘুম আসছে না?
না।
এক হাত খেলবেন?
তা খেলা যেতে পারে। ত্রিমাত্রিক পর্দায় দাবার গুটি ভেসে উঠল। ক্যাপ্টেন ক্লান্ত স্বরে বললেন, আমি আমার পুরান খেলা খেলব। পন কুইন ফোর।
কম্পিউটার সিডিসি বলল, নতুন পরিস্থিতে নতুন খেলা খেলতে হয় ক্যাপ্টেন।
তার মানে?
যখন পারিপার্শ্বিকতা বদলায়, তখন নিজেকেও বদলাতে হয়। আসুন, আজ আমরা নতুন খেলা খেলি।
সিডিসি, তুমি হেঁয়ালিতে কথা বলছ।
স্যার, আমি একটি যন্ত্রবিশেষ। যন্ত্রের মধ্যে আছে যুক্তি, হেঁয়ালি নয়। হেঁয়ালি আপনাদেরই একচেটিয়া।
ক্যাপ্টেন সুইচ টিপে সিডিসির সঙ্গে কাসেকশন কেটে দিলেন। তাঁর আর দাবা খেলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। মাথা ধরেছে। ঘুমানো দরকার।
কিন্তু ঘুম এল না। দীর্ঘ সময় কাটল এপাশ-ওপাশ করে।
কিছুক্ষণ কেবিনের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত পায়চারি করলেন। কেবিনের তাপমাত্রা নামিয়ে দিলেন দুডিগ্রি। তবু ঘুমের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। তিনি সুইচ টিপে আবার ডাকলেন সিডিসিকে, হ্যালো সিডিসি।
হ্যালো ক্যাপ্টেন। খেলাটা তাহলে শুরু করবেন?
না, আমি তোমাকে ডেকেছি ভিন্ন কারণে।
বলুন।
তুমি যদি গ্যালাক্সি-ওয়ানের ক্যাপ্টেন হতে, তাহলে কী করতে?
আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতাম।
ক্যাপ্টেনের ভ্রূ কুঞ্চিত হল। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, প্রাণীগুলিকে নিয়ে কী করতে?